দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আবারও বেড়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। এবার ছড়াচ্ছে ওমিক্রনের নতুন উপধরন ‘বিএফ.৭’। এতে বাংলাদেশেও করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ মোকাবিলায় ৪ দফা সুপারিশ করেছে সরকারের কোভিড বিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটি। এ অবস্থায় মাস্ক পরাসহ দ্রুত বুস্টার ডোজ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অন্যদিকে কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই দেশের সব বন্দরে স্ক্রিনিং জোরদারের নির্দেশনা সম্বলিত চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বিমানবন্দর, স্থলবন্দর থেকে শুরু করে সব জায়গায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অ্যান্টিজেন টেস্ট করে আইসোলেট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এদিকে চীনে নতুন করে ২৫ কোটিরও বেশি মানুষের দেহে করোনা শনাক্ত করা হয়েছে। ফলে ভারতসহ বাংলাদেশেও সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় করোনা সংক্রমণের নতুন ঢেউ মোকাবিলায় সরকারের কোভিডবিষয়ক জাতীয় কারিগরি কমিটি ৪ দফা সুপারিশ করেছে।

গতকাল সকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ‘বিশ্বে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘চীন-ভারতসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে আবারও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ছে।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত যাওয়া-আসা করছে। এ অবস্থায় করণীয় ঠিক করতে শনিবার জাতীয় কারিগরি কমিটির বৈঠক ছিল। কমিটি চারটি বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দিয়েছে।’

আহমেদুল কবির বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের নতুন ধরনের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো—টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের জন্য এটির ভয়াবহতা অনেক বেশি। তাই যারা টিকা নেয়নি, তাদের দ্রুত নিয়ে নেওয়ার জন্য কারিগরি কমিটি সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া সেকেন্ড বুস্টার ডোজের (চতুর্থ ডোজ) প্রচার বাড়ানোর বিষয়েও বলেছে কমিটি। সম্মুখসারির কর্মী, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও ষাটোর্ধ্ব যারা রয়েছেন, তাদের দ্বিতীয় বুস্টার ডোজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।’

তিনি আরও জানান, যাদের কোমরবিড কন্ডিশন রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রোটেকটিভ কেয়ার যেমন-মাস্ক ব্যবহার করা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করা এবং আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকার বিষয়ে কারিগরি কমিটি থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘কারিগরি কমিটির সভায় তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা হলো- বিমানবন্দর, স্থলবন্দরসহ সব বন্দরে পরীক্ষা জোরদার করা। রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক এরই মধ্যে বিভিন্ন বন্দরে চিঠি দিয়েছেন।

বিমানবন্দর, স্থলবন্দর থেকে শুরু করে সব জায়গায় সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের অ্যান্টিজেন টেস্ট করে আইসোলেট করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব দেশে করোনা শনাক্ত করা হচ্ছে, সেসব দেশ থেকে যারা আসবেন, তাদের মধ্যে উপসর্গ থাকলে দ্রুত পরীক্ষার আওতায় এনে যেকোনোভাবে এটিকে মোকাবিলা করার কথা বলা হয়েছে, যাতে নতুন ধরনটি দেশে ঢুকতে না পারে।’

অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, ‘এরই মধ্যে আমরা আইইডিসিআরকে নির্দেশনা দিয়েছি। যদিও দেশে বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি হচ্ছে না, তারপরও আমরা বলেছি, যাদের সংক্রমণ পজিটিভ আসবে তাদের যেন জেনেটিক সিকোয়েন্স করে সংক্রমণের নতুন ধরন আছে কি না সেটি পরীক্ষা করা হয়।’

আহমেদুল কবির আরও বলেন, ‘কারিগরি কমিটির সভায় বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বুস্টার ডোজে ফাইজারের যে টিকা দেওয়া হচ্ছে, সেটির মেয়াদ ফাইজার কোম্পানিই এক্সটেনশন করেছে। এ বিষয়ে ডিজিডিএ অ্যাপ্রুভাল দিয়েছে, জাতীয় কারিগরি কমিটিও বলেছে যে, সেই টিকা দ্রুত দিয়ে দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে এটি নিয়ে যেন কোনো কনফিউশন তৈরি না হয়, সে ব্যাপারেও কারিগরি কমিটি নির্দেশনা দিয়েছে।’

অনুষ্ঠানে কারিগরি কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘কোভিড সংক্রমণের নতুন ধরন নিয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। মানুষের মধ্যে সতর্কতা নেই বললেই চলে।’

তিনি বলেন, ‘মানুষ স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে একদম ভুলে গেছে। যেহেতু সংক্রমণ বাড়ছে, আবারও পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা জরুরি। আবারও সচেতনতা বাড়াতে হবে। বুস্টার ডোজ যারা নেয়নি, তাদের দ্রুত টিকা নিতে হবে।’ এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম বলেন, ‘টিকার মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে একটি ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। টিকা নিয়ে কনফিউশনের কারণ নেই। টিকা ম্যানুফ্যাকশন কমিটি টিকা নিয়ে কাজ করে। তাদের সঙ্গে কথা বলেই টিকার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এটি নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারাবিশ্বে করোনা মহামারি বেড়ে গেছে। চীনে অসংখ্য মানুষ আবারও আক্রান্ত হচ্ছে। টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের জন্য ভয় বেশি। কোমরবিডি কন্ডিশন যাদের রয়েছে, তারাও কিন্তু ঝুঁকিতে আছেন। তাই সবাইকে টিকা নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’

সংক্রমণের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সতর্ক রয়েছে জানিয়ে খুরশিদ আলম বলেন, ‘ডিএনসিসিসহ কোভিড হাসপাতাল যেগুলো রয়েছে, তাদের সঙ্গে আমরা মিটিং করছি। তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছি। আইসোলেশন ইউনিটগুলোকে প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। অধিদপ্তর সব বিষয় নিয়ে সতর্ক ও প্রস্তুত রয়েছে।’ চীনের উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রথম করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর তা মহামারি আকারে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এ বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসে নতুন উদ্বেগের কথা শোনা যাচ্ছে। যে ভ্যারিয়েন্টটি চীনে এসেছে সেটি হলো বিএফ৭, যা বিএ৫ এর সাব-ভ্যারিয়েন্ট। এটাকে বলা হয়, আর-১৮। আগে ভ্যারিয়েন্ট ছিল আর-৪, অর্থাৎ একজন থেকে ৪ জনকে আক্রান্ত করতে পারত। আর-১৮ একজন থেকে ১৮ জনকে আক্রান্ত করতে পারে। নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ক্ষমতা ৪ গুণ বেশি।

করোনাভাইরাসের ওমিক্রনের নতুন উপধরন বিএফ.৭-এ বিপর্যস্ত চীন। এরই মধ্যে ভারতসহ ৯১টি দেশে অতিসংক্রামক এ ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। ভাইরাসটি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ ও নমুনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করছে।

সম্প্রতি চীনে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরপরই প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি দেশবাসীকে মাস্ক পরার অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি ভাইরাসটির জিন বিশ্লেষণ করারও কথা বলেছেন।

জাতীয় টিকা প্রয়োগ কমিটির সদস্যসচিব ডা. মো. শামসুল হক জানান, আমরা সব স্কুলে টিকা দিয়েছি। কিছু শিক্ষার্থী বাদ পড়েছে। সেটা সারা ঢাকাতেই আছে। আমরা দুটি কেন্দ্র নির্ধারণ করেছি, যাতে কেউ বিভ্রান্ত না হয়। স্কুলে যখন দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেওয়া হবে, তখন যদি বাদ পড়া শিক্ষার্থী যায়, তাকে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হবে।

তিনি আরও বলেন, শিগগির দ্বিতীয় ডোজের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। স্কুল ছুটি থাকায় আমরা শুরু করতে পারিনি। হয়তো ১ জানুয়ারি থেকে এটা শুরু হয়ে যাবে। তখনই প্রথম ডোজের টিকা নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে করোনায় এ পর্যন্ত ২০ লাখ ৪০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ২৯ হাজার ৪৩৮ জন।