মিজানুর রহমান ও মাসুদ রানা, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ডলার সংকটে প্রভাব পড়েছে দেশের পুঁজিবাজারে। এতে করে ডরিন পাওয়ার, ওয়ালটন, ডেসকো রেনেটার মতো বড় বড় কোম্পানির আয়ে প্রভাব ফেলেছে। যে কারণে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ প্রদানের হারও কমেছে। কোম্পানিগুলোর প্রকাশিত নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন ও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, সম্প্রতি যেসব কোম্পানি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোম্পনিগুলো হলো: রেনেটা লিমিটেড, ডরিন পাওয়ার লিমিটেড, বিবিএস কেবলস লিমিটেড, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ, পেনিনসুলা চিটাগং লিমিটেড এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো)।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে কাঁচামাল আমদানির বিপরীতে এলসি খোলার জন্য পর্যাপ্ত ডলার না পাওয়ায় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার বাড়ার ফলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর আয় কমেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ডরিন পাওয়ার লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জুনে সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডরিন পাওয়ার ৬৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা মুনাফা করেছে।

আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ১৬৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সে হিসাবে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির আয় কমেছে ১০২ কোটি টাকা বা ৬১ শতাংশ। সর্বশেষ বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) ছিল ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। আগের বছর শেয়ারপ্রতি ৯ টাকা ২১ পয়সা আয় হয়েছিল। সে হিসাবে ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২৩ অর্থবছরে ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেমস লিমিটেডের শেয়ারপ্রতি সমন্বিত আয় (ইপিএস) কমেছে ২ দশমিক ৫৯ গুণ।

এ ব্যাপারে ডরিন পাওয়ারের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ আমজাদ শাকিল বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যানের কারণে কোম্পানিটির আয় কমেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল ফার্নেস অয়েল আমদানির জন্য আমরা যে রেটে এলসি খুলেছিলাম, সে এলসি নিষ্পত্তিতে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে কোম্পানিটির আয়ের ওপর।

কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ আলোচ্য হিসাব বছরে উদ্যোক্তা পরিচালক বাদে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ১১ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ডরিন পাওয়ার লিমিটেডের গত ছয় বছরের মধ্যে লভ্যাংশ প্রদানের এ হার সর্বনিম্ন। আগের অর্থবছরে কোম্পনিটি ১৮ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছিল।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অপর কোম্পানি বিবিএস ক্যাবলস লিমিটেডের মুনাফা গত ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে ৮৮ শতাংশ কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটির মুনাফা হয়েছে ৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৮০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। আলোচ্য অর্থবছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ৪৬ পয়সা।

২০২১-২২ অর্থবছরে ইপিএস ছিল ৩ টাকা ৮১ পয়সা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোম্পানিটি জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে কাঁচামাল কিনতে খরচ বেড়ে যায়। যার কারণে ইপিএস কমেছে।

এ প্রসংগে বিবিএস ক্যাবলস লিমিটেডের কোম্পানি সচিব মো. গোলাম হাবিব বলেন, আমাদের কোম্পানির কাঁচামাল যেহেতু আমদানি করতে হয় তাই ডলার সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমার ফলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বিপরীতে পণ্যের দাম বাড়াতে পারিনি। তাই আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমাদের বিক্রয় বাড়লেও মুনাফা কমেছে।

২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানিটি ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ২০১৭ সালে তালিকাভু্ক্িতর পর এটাই বিবিএস ক্যাবলসের ঘোষিত সর্বনিম্ন মুনাফা। এর আগের অর্থবছরে বিবিএস কেবল ৮ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছিল। ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে দেশীয় বড় কোম্পানি ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজের মুনাফা এক বছরে প্রায় ৩৬ শতাংশ বা ৪৩৩ কোটি টাকা কমেছে।

এ কারণে গত তিন বছরের মধ্যে কোম্পানিটির মুনাফা সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। গত জুনে সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওয়ালটন প্রায় ৭৮৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এর আগের বছরে অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে কোম্পানিটি মুনাফা করেছিল ১ হাজার ২১৬ কোটি টাকা।

সম্প্রতি প্রকাশিত কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিদেন অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে এই কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমে ২৫ টাকা ৮৪ পয়সা হয়েছে, যা আগের ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে ছিল ৪০ টাকা ১৬ পয়সা। ডিএসইতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোম্পানিটি বলেছে, ডলারের দামে অস্থিরতার কারণেই মূলত কোম্পানিটি বড় অঙ্কের মুনাফা হারিয়েছে।

পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ভ্রমণ ও অবকাশ খাতের কোম্পানি পেনিনসুলা চিটাগং লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ গত ৩০ জুন ২০২৩ সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের ফলে কোম্পানিটির পণ্য বিক্রির খরচ এবং প্রশাসনিক ব্যয় বাড়ার কারণে তাদের আয় কমেছে বলে জানিয়েছে কোম্পানিটি। সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৩৪ পয়সা। আগের অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি ১৯ পয়সা আয় ছিল।

পুঁজিবাজারে তালিকাভ্ক্তু আরেক কোম্পানি ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) আয় কমেছে আশঙ্কাজনক হারে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) সম্প্রতি প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৪২ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। আগের বছর কোম্পানিটি ৬৩ কোটি টাকা মুনাফা করেছিল।

কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে বিদেশি ঋণ পরিশোধের কারণে লোকসান হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। আলোচ্য সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি ১৩ টাকা ৬৫ পয়সা লোকসান হয়েছে। আগের বছর শেয়ারপ্রতি ১ টাকা ৫৯ পয়সা আয় হয়েছিল। এই লোকসানের ৪২৮ কোটি টাকা কেবল ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে হয়েছে।

বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ডেসকো এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ঋণ নিয়েছে। ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ রয়েছে ডেসকোর।

এদিকে রেনাটা লিমিটেড সমাপ্ত অর্থবছরে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য নগদ ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। চলতি বছরের জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন মুনাফা অর্জন করেছে কোম্পানিটি। আগের বছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে কোম্পানির নিট মুনাফা কমেছে ২৭৯ কোটি টাকা বা ৫৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ফলে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশের পরিমাণ অর্ধেকের নিচে নামিয়ে এনেছে কোম্পানিটি।

মুনাফা কমার কারণ হিসেবে মূল্যস্ফীতি, বিভিন্ন ধরনের ব্যয় বৃদ্ধির চাপ এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় জনিত লোকসানকে দায়ী করছে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে আগামী প্রান্তিকেই ভালো মুনাফায় ফেরার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে কোম্পানির সচিব মো. জুবায়ের আলম বলেন, ‘বেশ কিছু কারণে বিক্রি বাড়া সত্ত্বেও মুনাফা কমে গেছে। মূল্যস্ফীতি, জাহাজীকরণের ব্যয় বাড়ার কারণে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুতের ব্যবহার ও দাম বৃদ্ধি, বিক্রয় ও বিপণনে জোর দেওয়া, আমদানির ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়জনিত লোকসান বৃদ্ধি এবং নতুন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি সার্বিকভাবে কোম্পানির মুনাফা কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। তবে আগামী কোয়ার্টার থেকে আমরা আবারও ভালো মুনাফায় ফিরতে পারব বলে আশাবাদী।’