আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকার হটানোর দাবি নিয়ে গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করে অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাদের সঙ্গে একই কর্মসূচি পালন করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। সেই সমাবেশ থেকেই নানা নাশকতা-সহিংসতার শুরু। এবার নাশকতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেন। মুলত দুর্বৃত্তদের টার্গেট এবার রেললাইনে। তারা রেললাইনকে ঘিরে ছক কষছে।

দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ ধরনের চক্রান্ত হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তারা গত সপ্তাহে বুধবার ভোরে গাজীপুরে রেললাইন উপড়ে ফেলে। এতে রেল দুর্ঘটনায় একজন নিহত হন। আহত হন অনেকেই। ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই বুধবার রাতে নীলফামারীতে রেললাইনের ৭২টি ফিসপ্লেট খুলে ফেলেছে দুর্বত্তরা। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পায় সীমান্ত এক্সপ্রেস।

এর পর গত মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে আসা ‘মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস’ট্রেনের তিনটি বগিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে এক নারী ও তার শিশুসন্তানসহ ওই ট্রেনের চার যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ২৬ জেলায় নতুন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে পুলিশি টহলের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।

স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে যে কোনো অপ্রীতিকর ও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রেল মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি ফোর্স চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠি যাচাই-বাছাই করে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, সড়কে র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক টহলের কারণে দুর্বৃত্তরা কোনো ধরনের নাশকতা ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারণে তারা রেললাইনকে বেছে নিয়েছে। রেললাইনে সাধারণত কোনো টহল থাকে না। নিয়মিত টহল দেয়ার সুযোগও খুব কম। এ কারণে নির্জন স্থানের রেললাইনে নাশকতার জন্য ফিসপ্লেট খুলে ফেলা বা রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।

তবে তিনটি ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানের রেললাইনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আনসার সদস্যদের উপস্থিতিও। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গতিতে রেল চালানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সূত্র মতে, তিনটি ঘটনার পর সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দেশের ২৬ জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

যাতে কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা কোনো ধরনের ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালানো মাত্র তাকে আইনের আওতায় আনা যায়। এছাড়া ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অন্য কোনোভাবে কেউ যাতে কোনো গুজব ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারেও পুলিশের সাইবার ইউনিটকে সতর্ক করা হয়েছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত ৫১ দিনে মোট পাঁচটি ঘটনায় ৭টি কোচ পুড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে সাতটি কোচ। নিহত হয়েছেন পাঁচ জন, আহত অর্ধশতাধিক। রেলের নিরাপত্তায় সকলের সহযোগিতা চেয়েছেন রেলপথমন্ত্রী। রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ‘রেল লাইন উপড়ে ফেলা, আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা, কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতি হতে পারে না।’ মন্ত্রণালয় বলছে, রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা সারাদেশে ঘটেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেন।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ৫১ দিনে মোট পাঁচটি সহিসংসতার ঘটনা ঘটেছে ট্রেনে। যার শুরু হয় গত ১৬ নভেম্বর। টাঙ্গাইলে কমিউটার ট্রেনে দাঁড়ানো অবস্থায় আগুন দেওয়া হয়। ওই ট্রেনের দু’টি কোচ পুড়ে যায়। একটি কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয় সহিংসতার ঘটনা ঘটে ১৯ নভেম্বর। জামালপুরের সরিষাবাড়িতে দাঁড়ানো অবস্থায় থাকা ৭৪৫ নম্বর ট্রেন ‘যমুনা এক্সপ্রেসে’ আগুন দেওয়া হয়। সে ঘটনায় দু’টি কোচ পুড়ে যায়। এরপর ২২ নভেম্বর সিলেটে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন উপবন এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়।

সে ঘটনায় আরেকটি কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ১৩ ডিসেম্বর গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ২০ ফুট রেল ট্রাক কেটে ফেলা হয়। এতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ট্রেনের সাতটি বগি ছিটকে যায়। তাতে একজন নিহত হন এবং এলএম এএলএমসহ কয়েকজন আহত হন। ওই দুর্ঘটনায় একটি লোকোমোটিভ ও ছয়টি কোচ ব্যপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ট্রেনটি ধীরগতিতে চলছিল বলে তুলনামূলক ক্ষতি কম হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

এরপর সর্বশেষ ১৯ ডিসেম্বর তেজগাঁও রেলস্টেশনে। চলন্ত ট্রেনে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে শিশুসহ চারজন নিহত হয়েছে। তিনটি কোচ একেবারের পুড়ে যায়। রেলপথমন্ত্রী জানিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে দুস্কৃতকারীরা গান পাউডার নিয়ে যাত্রী বেশে ট্রেনে উঠেছিল। সুযোগ বুঝে আগুন লাগিয়ে দেয়।  তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে ট্রেনে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ট্রেনকে নিরাপদ করতে প্রত্যেকের সহযোগিতা চাই।’

রেলে সহিংসতা ফৌজদারি অপরাধ উল্লেখ করে বলেন, ‘ফিসপ্লেট তুলে ফেলার ঘটনায় পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করেছে। রেল নিরাপদ রাখতে আমরা লাইন চেক করা বাড়িয়েছি। ট্রেনের নিরাপত্তা বাড়াতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে রেলমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা ২৭০০ রেল পুলিশ চেয়েছি। সেটা প্রক্রিয়াধীন।’