দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দফায় দফায় দাম বৃদ্ধির পরও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু আবাসিকেই নয়, গ্যাসের তীব্র গ্যাস সংকট রয়েছে শিল্প কারখানাতেও। গ্যাস সংকটে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম যমুনা সার কারখানা। স্বল্প চাপের কারণে সিএনজি স্টেশনগুলোতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে যানবাহনের মালিকদের। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো বিদেশী ক্রেতাদের পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর আবাসিক এলাকায় প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত একেবারেই গ্যাস মিলছে না। অনেক এলাকায় রাত ১২টার দিকে এসে আবার ভোরেই চলে যায় গ্যাস। আগে কিছু এলাকা কেন্দ্রিক গ্যাস সংকট থাকলেও এখন রাজধানীজুড়ে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।

এদিকে গ্যাস তো এখন আর যায় না, তবে মাঝে মাঝে আসে। কখন আসে তা জানার জন্যও আপনাকে জাগতে হবে রাত। নিশি কুটুম্বের মতো রাতের আঁধারে আসে, ভোরের আলো ফোটার আগেই উধাও হয়ে যায়। তারপরও সংযোগ বিচ্ছিন্নর ভয়ে নিয়মিত বিল পরিশোধ করে যাচ্ছি। কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর খিলক্ষেত উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মোসা. শিমলা বেগম। শুধু শিমলা বেগম নয়, রাজধানীর বেশিরভাগ এলাকার চিত্র একই। গ্যাসের অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটে গৃহণীদের।

দেশজুড়ে বইছে তীব্র শীত। আর এ শীতের দাপটে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র গ্যাস সংকট। অনেক এলাকাতেই গ্যাস থাকছে না সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। ভুক্তভোগীরা দাবি করেছেন রাজধানীতে গ্যাসের সরবরাহ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। চুলা না জ্বলায় খাবার খেতে হচ্ছে দোকান থেকে কিনে। আর এ অনাকাঙ্ক্ষিত গ্যাস সংকট নগরবাসীকে কতদিন ভোগাবে উত্তর জানা নেই কারোরই। তবে শিগগিরই গ্যাস সংকটের সমাধান হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের চাপ কম থাকায় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন নগরবাসী। তাদের দাবি, বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানীজুড়ে গ্যাসের মারাত্মক সংকট চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই গত কয়েকদিন রাত থেকে বেশ কিছু এলকায় গ্যাস আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

ফলে অনেকেরই বাসাবাড়িতে রান্না-বান্না বন্ধ রয়েছে। হোটেল থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে খাবার। জানা গেছে, রাজধানীতে প্রায় বছর জুড়েই থাকে গ্যাসের সংকট, যা প্রকট হয় শীতকালে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজধানীর বেশ কয়েকটি দেখা দিয়েছে তীব্র গ্যাস সংকট। দিনের অধিকাংশ সময়ই গ্যাসের দেখা মিলছে না রাজধানীর অনেক এলাকায়।

গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে আবাসিক এলাকাগুলোতে। শীতের দাপট যতই বৃদ্ধি পেয়েছে গ্যাসের সংকট ততই আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী চাকরিজীবীরা। রাজধানীর হীরাঝিল বস্তির নারীরা। ২টি করে মোট ৪টি গ্যাস সংযোগের চুলা থাকলেও তাদের ভরসা মাটির চুলা।

হীরাঝিল বস্তির বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, সকাল ৩টা বাজে গ্যাস আসলে ৭টা বাজতে বাজতে গ্যাস চলে যায়। সামনে আরও সংকটের সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে রাজধানীতে যারা ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, ভালো নেই তারাও। গত শনিবার ছুটির দিনেও দিনভর অপেক্ষা শেষে তাদের শেষ ভরসা এলপি সিলিন্ডার।

মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের ডি ব্লকের বাসিন্দা নাজমা বেগম জানান, সকাল ৪টা বাজে ঘুম থেকে উঠে রান্না করতে হয়। সরকারি বন্ধের দিনও গ্যাস থাকে না। সকাল ৬টা বাজতে না বাজতেই গ্যাস চলে যায়। লাইনে টিপ টিপ করে গ্যাস আসায় রান্নাবান্না বন্ধের উপক্রম হয়েছে। আর তাই রান্নাবান্নার কাজ আগেই শেষ করে রাখতে হয়। তিনি বলেন, গ্যাস না থাকলেও মাস শেষে পুরো বিলই পরিশোধ করতে হচ্ছে। নিয়মিত বিল পরিশোধ করলেও আমাদের পর্যাপ্ত সেবা তো দূরে থাক স্বাভাবিক সেবাটুকুও পাচ্ছি না।

আবার গত সাড়ে তিন বছরে কখনো গ্যাসের সমস্যা দেখেননি ধানমন্ডি ৭/এ— এর বাসিন্দা দীপিকা রহমান। কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকে এখানেও সমস্যা হচ্ছে। তিনি বলেন, বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ খুবই কম থাকে। এক পাতিল পানি গরম করতেও আধ ঘণ্টার বেশি সময় লাগে।
সংকট আরও তীব্র গুলশান ৯০ নম্বর সড়কের বাড়িগুলোতে।

এসব এলাকা ছাড়াও রাজধানীর জিগাতলা, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান, সেন্ট্রাল রোড, মোহাম্মদপুরের কাটাসুর, আদাবর ১০ নম্বর, মগবাজারের মধুবাগ, মিরপুর, আজিমপুরের একাংশ, যাত্রাবাড়ীর রসুলপুর, মানিকনগর, খিলক্ষেত, উত্তরার ৩ ও ১০ নম্বর সেক্টর এবং তুরাগের হরিরামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সংকটের তথ্য পাওয়া গেছে।

গ্যাস সংকটে অন্তত ২৫ শতাংশ উৎপাদন কমেছে মিরপুরের এ প্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের। উদ্যোক্তারা বলছেন, এলপিজি ব্যবহার করেও স্বাভাবিক রাখা যাচ্ছে না উৎপাদন। এ প্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শাহজাহান সাজু বলেন, আগে আমরা ২০ হাজার পণ্য উৎপাদন করতাম। এখন সেটা করতে পারি ১৬ থেকে ১৭ হাজার। এই এলাকায় গ্যাসের প্রচুর সমস্যা। দেশের সার্বিক অর্থনীতির কথা বিবেচনা করে নতুন শিল্প-কারখানায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া জরুরি।

পেট্রোবাংলার হিসাবে বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪০০ কোটি ঘনফুট। বিপরীতে ১৩ ডিসেম্বর জোগান দেয়া গেছে মাত্র ২৪৪ কোটি ঘনফুটের। ফলে ঘাটতি ছিল চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ। যার মূল কারণ দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ রয়েছে এলএনজির পর্যাপ্ত সরবরাহ। আর এমন অবস্থা থেকে শিগগিরই উত্তরণ ঘটার সম্ভাবনাও কম। পেট্রোবাংলার পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী বলেন, ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করে আমরা জাতীয় গ্রিডে দিচ্ছি। এটা এখনো বিদ্যমান আছে।

২০২৬ সালের পর গ্যাসের চাহিদা বাড়বে। স্থানীয় জোগানের সঙ্গে এলএনজি আমদানি করে সেটা মেটানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। হঠাৎ গ্যাসের এমন সংকট সম্পর্কে জানতে দায়িত্বশীল কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীতে সরবরাহ লাইনে একধরনের ‘আর্দ্রতা’ জমে। এতে গ্যাসের চাপ একটু কমে যায়। ফলে চুলাতেও গ্যাসের চাপ কমে। কিন্তু এখন যে সংকট চলছে, তার মূলে রয়েছে গ্যাসের জোগানে ঘাটতি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দেশে এখন দিনে গ্যাসের চাহিদার বড় একটি অংশ আসে দেশে উৎপাদিত প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। বাকি অংশের জোগান দেয়া হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) মাধ্যমে।

তিতাস গ্যাসের অভিযোগ কেন্দ্রের কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ উভয় সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ কিছুটা কম রয়েছে বলে সম্প্রতি তাদের কাছেও অভিযোগ এসেছে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহ কী কারণে বন্ধ রয়েছে তা এখনই ঠিক বলা যাচ্ছে না।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, গ্যাসের অভাবে দিনের পর দিন বাসাবাড়িতে রান্না বন্ধ থাকলেও নির্বিকার তিতাস কর্তৃপক্ষ। বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন ছাড়াও তীব্র গ্যাস সংকটে ধ্বংস হচ্ছে শিল্প-কারখানাও। শিল্পে নতুন সংযোগ বন্ধ রাখাসহ নানা উদ্যোগ নিয়েও সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না। বরং দিন যতই গড়াচ্ছে গ্যাসের সংকট আরও বাড়ছে। শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে গ্যাস সংকটের কারণে বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।

গ্যাস সংকট সমাধানে মার্চ পর্যন্ত সময় চেয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সারা দেশে গ্যাসের সংকট চলছে। তবে সেটি শিগগিরই কেটে যাবে। আমরা আশা করছি এ অসুবিধা খুব সাময়িক। প্রচণ্ড শীতের কারণেও গ্যাসের চাপ কিছুটা কমে গেছে। মেরামতে থাকা এলএনজির দ্বিতীয় টার্মিনালটি দু-একদিনের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। তখন গ্রিডে দৈনিক ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গ্যাস সংকট প্রসঙ্গে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, অবৈধ লাইনের কারণে ভোগান্তিতে আছেন বৈধভাবে যারা গ্যাস সংযোগ নিয়েছেন তারা। তিনি বলেন, পাঁচজনের খাবার দশজনে খাইলে যেটি হয়, তা-ই হচ্ছে। প্রতি বছরই শীতে ঢাকায় তিতাসের লাইনে সরবরাহ করা গ্যাসের কমবেশি সমস্যা হয়। এ বছর এ সমস্যা প্রকট হয়েছে। রাজধানীতে গ্রীষ্মে এ অনাকাঙ্ক্ষিত গ্যাস সংকট নগরবাসীকে কতদিন ভোগাবে উত্তর জানা নেই কারোরই। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের

মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. সেলিম মিয়া বলেন, ‘গ্যাসের সাপ্লাই কম এজন্য এ সমস্যাটা হচ্ছে। একটা এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ আছে। ওটা চালু হলে ইমপ্রুভ হবে। শুনছি আরেকটা এলএনজি আসবে। এগুলো মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে। আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’