মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আবাসিক ভবনে রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন না থাকলেও নিয়ম ভেঙে গাদাগাদি করে চলছে নামিদামি সব রেস্টুরেন্ট। জরাজীর্ণ ভবনে ছোট্ট সিড়িই আসা যাওয়ার একমাত্র পথ, কোনো কোনো জায়গায় সেটিও বন্ধ থাকে। কাঁচঘেরা এসব রেস্টুরেন্ট যেন এক একটি মৃত্যুপুরী। প্রতিটি রেস্টুরেন্টে ঝুঁকিপূর্ণভাবে একাধিক সিলিন্ডার পাশাপাশি রেখে ডজনখানেক চুলায় দিনভর চলে রান্না। বেইলি রোডে আগুন লাগা গ্রিন কজি কটেজ লাগোয়া আরেকটি ভবন গোল্ডেন প্যালেসে বড় বড় সব নামিদামি রেস্টুরেন্ট।

আবাসিক ভবনটির পঞ্চম তলা জুড়েই রয়েছে রেস্টুরেন্টসহ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, একটির সঙ্গে আরেকটি লাগোয়া। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, নিচ থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ওঠার সিঁড়ি একেবারেই সরু। সিড়ির পাশেই রাখা আছে নানা সামগ্রী। গোল্ড প্যালেস ভবনটিতে ৫টি রেস্টুরেন্ট, একমাত্র সিড়িটা বন্ধ ছিল যা দুর্ঘটনার পর পরিষ্কার করা হচ্ছে। আশপাশের পড়ে থাকা স্থাপনা দেখেই বোঝা যায়, পাশের ব্লিডিং এ দুর্ঘটনার পর থেকে পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু হয়। ভবন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন যেন এ সিড়ি ব্যবহারের উপযুক্ত হয়।

ফলে এমন চিত্র বেইলি রোডে নয় পুরো রাজধানীর গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি, মিরপুর, মোহাম্মদপুরের মতো অভিজাত এলাকার।বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী, দেশে রেস্তোরাঁর সংখ্যা ৪ লাখ ৮১ হাজার। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে প্রায় ২৫ হাজার। এসব ভবনে নেই পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা।

নগর গবেষক স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে, ভবনগুলো যেন একেকটা টাইমবোমা। অগ্নিনিরাপত্তার অনুপস্থিতির পাশাপাশি রয়েছে অগ্নিঝুকিঁও। ভবনগুলোর প্রতিটি ফ্লোরে রয়েছে রান্নাঘর। এসব রান্নাঘরে ব্যবহার করা হয় সিলিন্ডার গ্যাস। আগাম এনে স্তূপাকারেও রাখা হয় গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, আইনে আছে হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ করতে গেলে অবশ্যই রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির ছাড়পত্র লাগবে। এই ছাড়পত্র থাকলেই শুধুমাত্র সরকারি সংস্থাগুলো ব্যবসার অনুমতি দেবে। রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে গেলে সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিসসহ মোট ১৩টি সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন লাগে। কিন্তু এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলো এই আইন না মেনে দেদারসে রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন দিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই যত্রতত্র বেড়ে চলেছে রেস্তোরাঁর সংখ্যা।

বেইলি রোড দুর্ঘটনার পর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, বাণিজ্যিক অনুমোদন নিয়ে ভবনটিতে ফুড ইন্ডাস্ট্রি চালানো হচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলছেন, ‘ভবনটি বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) না মেনে তৈরি করায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।’ তবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমলে না নিয়েই সিটি করপোরেশন বেইলি রোডের ওই প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলছে, বেইলি রোডের ওই ভবনে আটটি রেস্তোরাঁর মধ্যে মালিক সমিতির সদস্য মাত্র একটি। বাকি সাতটি প্রতিষ্ঠানই মালিক সমিতির ছাড়পত্র ছাড়া বেআইনিভাবে ট্রেড লাইসেন্স পেয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রোস্তারাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, রেস্তোরাঁ ব্যবসা করতে মালিক সমিতির ছাড়পত্র গ্রহণের আইন বাধ্যতামূলক থাকা সত্ত্বেও সেটা মানছে না সিটি করপোরেশনসহ অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আমরা একটা প্রস্তাবনা প্রস্তুত করছি। শিগগিরই এটি সরকারের কাছে পেশ করব। অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান হাসান বলেন, বেইলি রোডের ওই ভবনে যে রেস্তোরাঁগুলো রয়েছে তার মধ্যে মাত্র একটি রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সদস্য। কাচ্চি ভাই’ও সদস্য না। অথচ মালিক সমিতির ছাড়পত্র না থাকলে লাইসেন্সই পাওয়ার কথা না।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সদস্যরা দেশের পোশাক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর আদলে কাজ করতে চায়। বিজিএমইএ যেভাবে পোশাক কারখানাগুলোর কমপ্লায়েন্স মনিটরিং করে সেভাবে রেস্তোরাঁগুলো মনিটরিংয়ের ক্ষমতা চায় মালিক সমিতি। এক্ষেত্রে মালিক সমিতির দাবি, সরকারি সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়েই সমিতি কাজটি করতে চায়। লাখ লাখ রেস্তোরাঁ নিয়মিত মনিটরিং করার মতো সক্ষমতা সরকারি প্রতিষ্ঠানের নেই।

রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, মনিটরিংয়ের ক্ষমতা মালিক সমিতিকে দিতেই হবে। না হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আমরা অচিরেই এ ব্যাপারে একটা প্রস্তাবনা সরকারের কাছে দেব। বেইলি রোডের ওই ভবনের মতো শত শত ভবন ঢাকা শহরে রয়েছে। অলিগলি থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকায় যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই গড়ে তোলা হয়েছে ফুড ইন্ডাস্ট্রি।

রাজউকের ছয় সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে বেইলি রোডের ভবনটি পরিদর্শন করেছে। কমিটির পর্যবেক্ষণ হলো, ভবনটিতে কোনো ফায়ার এক্সিট ছিল না। জরুরি পরিস্থিতিতে বের হওয়ার পথ ছিল না। বিশেষভাবে নির্মিত ওই বহির্গমন গেট আগুনের মধ্যেও দুই ঘণ্টা পর্যন্ত অক্ষত থাকে। ফায়ার এক্সটিংগুইসারসহ কোনো ব্যবস্থাই ভবনটিতে ছিল না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক নগর গবেষক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, যে কাজের কথা বলে ভবনের অনুমতি নেওয়া হয় সেই কাজের বাইরে অন্যকিছু করার সুযোগ নেই। কাজেই বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ করার সুযোগ নেই। কারণ রেস্তোরাঁয় রান্না করার দরকার হয়। সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকতে হয়। তিনি বলেন, গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকার বিভিন্ন বহুতল ভবনে যেসব রেস্তোরাঁ হয়েছে সেগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।