আবদুর রহমান ও মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা আবারও আস্থার সংকটে পড়েছেন। নতুন বছর শুরুর তিন মাস যেতে না যেতেই উল্টো পথে দেশের পুঁজিবাজার। আস্থা সংকটের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বড় বিনিয়োগকারীরা সাইডলাইনে অবস্থান করছেন। ফলে প্রতিনিয়তই কমছে লেনদেন ও শেয়ারের দাম। পরিস্থিতি এতো খারাপ হয়েছে যে, সপ্তাহজুড়ে ডিএসই ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) বাজার মূলধন উধাও ২২ হাজার ৫৬ কোটি ১৫ লাখ টাকার বেশি। তাতে আস্থা সংকটের পর তারল্য সংকটও দেখা দিয়েছে পুঁজিবাজারে। এছাড়া ১৫ কার্যদিবসের ব্যবধানে ৩৩৬ পয়েন্ট সূচক উধাও হয়ে গেছে।

ডিএসইতে টানা দরপতনের ফলে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা। কারণ ফ্লোর প্রাইসে তোলার পর বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ফ্লোর ইস্যু কাটতে না কাটতে ‘জেড ক্যাটাগরি’ ইস্যুতে নতুন করে পুঁজিবাজারে দরপতনে বড় ক্ষতির মুখে পড়ছে বিনিয়োগকারীরা। বিনিয়োগকারীরা অভিযোগের সুরে বলেন, ২০১০ সালের চেয়ে বড় ক্ষতির মুখে বিনিয়োগকারীরা। ২০১০ সালে এ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বিনিয়োগকারীরা। বর্তমান কমিশন আসার পর বিনিয়োগকারীরা ধাপে ধাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেমনি মার্জিন ঋণের ফাঁদে বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হয়ে গেছেন।

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারকে ঘিরে যেসব বিনিয়োগকারী আশার বীজ বুনেছিলেন, তারাই এখন পুঁজিবাজার ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। পুঁজিবাজারকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সরকারি উদ্যোগের কমতি না থাকলেও কারসাজিকারক এবং সুবিধাভোগী এক শ্রেণির কূটচালে ভন্ডুল হচ্ছে যাবতীয় পরিকল্পনা। নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই বিলীন হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের স্বপ্ন। আর তাদের পোর্টফলিও (পত্রকোষ) থেকে প্রতিনিয়তই উধাও হচ্ছে টাকা। কখনো জেড ক্যাটাগরি আবার কখনো সরকারবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করে শেয়ারের দাম কমাচ্ছে কুচক্রীমহল।

বাজার সংশ্লিষ্টরা এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। জেনে-বুঝে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হয়ে শেয়ার বিক্রি না করার পরামশ দিয়েছেন তারা। এছাড়া দেশের অর্থনীতির সব ধরনের সূচকই ইতিবাচক রয়েছে। গত মাসে রেমিটেন্স এবং রপ্তানি আগের তুলনায় বেড়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন পরবর্তী যে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে জুজুর ভয় দেখানো হয়েছিল, সেটিও এখন কেটে গেছে।

বর্তমানে দেশের বৈদেশিক রিজার্ভ ফের ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। যখন দেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলছে সেখানে পিছিয়ে পড়ছে পুঁজিবাজারের সূচক। মূলত গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ার কারণেই পুঁজিবাজারের এই করুণ দশা। তাই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড একচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) চাইলে ওই সব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে কঠোর হতে পারে না। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিএসইসি চেষ্টাও করেছে কিন্তু তাতে সফল হয়নি।

সম্প্রতি দেশের পুঁজিবাজারে কোম্পানিগুলোর দর কমার সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর প্রাইস) কয়েক ধাপে প্রত্যাহার করে নেয় বিএসইসি। পুঁজিবাজারে কার্যরত প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের বড় বিনিয়োগকারীদের দাবি ছিল স্থিতিশীলতা ফেরাতে ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহার করতে হবে। সব পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি এটি প্রত্যাহার করে নেয়। এর পর থেকে শেয়ারবাজারটি মোটামুটি ভালোই চলছিল। তবে ভালো কোম্পানির পাশাপাশি মন্দ ও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা কোম্পানিগুলোর দর অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছিল।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কমিশন বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘ মেয়াদে স্বার্থের কথাটি বিবেচনায় নিয়ে পর পর দুই বছর লভ্যাংশ না দেওয়া, নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা না করা, ছয় মাস ধরে উৎপাদন বন্ধ এবং রিজার্ভের তুলনায় লোকসান বেশি এসব কোম্পানিকে পর্যায়ক্রমে জেড ক্যাটাগরিতে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ঠিক সুযোগ সন্ধানীরা যেন বিএসইসির এই নির্দেশনার সুযোগকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। নির্দেশনা জারির পর থেকেই শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিক্রির চাপ দিয়ে অস্থির করে তুলছে। প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় শেয়ার দর ও লেনদেন কমছে। এভাবেই বাজারবিমুখ হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে মূল সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট। এই সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। না হলে দীর্ঘমেয়াদে বাজার টেকসই হওয়া কঠিন।

অর্থনীতিবিদ ও বাজারসংশ্লিষ্টদের মতে, মোটা দাগে বাজারে দুটি সংকট। চাহিদার দিক থেকে সংকট হলো এই বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেই। সরবরাহের দিক থেকে সংকট হলো ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম। ফলে কারসাজি ও সিন্ডিকেটের জয়জয়কার অবস্থা। সবকিছু মিলে দীর্ঘদিন থেকে দুর্বল অস্তিত্বে টিকে আছে পুঁজিবাজার। আর ক্রমেই অবস্থা আরও দুর্বল হচ্ছে। এখান থেকে দীর্ঘমেয়াদে উত্তরণ একেবারেই কঠিন।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী কাজী হোসাইন আলী বলেন, পুঁজিবাজার স্থিতিশীল করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সবার আগে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে এই মর্মে বিনিয়োগকারীদের নিশ্চয়তা দিতে হবে। তা হলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরে আসবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিন পার করলেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার পরিপক্ব আচরণ করছে না। তালিকাভুক্ত বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার দর এখন কেনার মতো লোভনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কিন্তু ওই সব শেয়ারে ক্রেতা মিলছে না। উল্টো দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন বন্ধ ও লোকসানী কোম্পানিকে ঘিরে চলছে কারসাজি। এটি সুস্থ পুঁজিবাজারের কোনো লক্ষণ নয়।