দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আগামী বাজেটে কালোটাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) সাদা করার ‘বিশেষ সুবিধা’ দেওয়া যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে এ পদক্ষেপের বিপক্ষে আছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এ বিষয়ে ভিন্ন মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অনেকে বিনা শর্তে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে থাকলেও অনেকে আবার এর ঘোর বিরোধিতা করেছেন।

এদিকে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কোন কোন খাতে, কী সুবিধা এবং কত দিনের জন্য দেওয়া হবে তা উল্লেখ করে এনবিআর প্রতিবেদন পাঠাবে, যা খতিয়ে দেখে সংযোজন-বিয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে। এখানে যাচাই-বাছাই করে আগামী বাজেটে ‘বিশেষ সুবিধায়’ কালোটাকা সাদা করা হবে কি না, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এনবিআর বাজেট প্রস্তুত কমিটির এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আদায় বাড়াতে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে না এনবিআর। তবে তা কতটা কার্যকর করা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ আইএমএফের এ বিষয়ে আপত্তি আছে।

এদিকে সরকারের আয় কমেছে। নিয়মিত অনেক খরচও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অর্থ জোগাড়ে বাধ্য হয়েই দেশি বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ডলারসংকট চলছে। বাংলাদেশে ডলারসংকটের কারণে সাধারণ ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারছেন না। আমদানি-রপ্তানিতে স্বাভাবিক ধারা নেই।

ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাজস্ব আদায়ে ধস নেমেছে। চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি এরই মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সরকারের আয় বাড়াতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার বিশেষ সুবিধা দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে হিসাব কষতে বসেছে সরকার।

সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ সামনে রেখে এরই মধ্যে এনবিআরের তৈরি প্রাথমিক প্রতিবেদনে সীমিত ছাড় দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ডলারসংকটের কারণে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

আন্তর্জাতিক কারণে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। অনেক পণ্য বিক্রি কমেছে। সামগ্রিকভাবে কর ভ্যাট ও শুল্ক খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগে সীমিত সুবিধা দিয়ে উৎসাহিত করা হলে রাজস্ব আদায়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে ঢালাওভাবে এ সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য করেছে এনবিআর।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থনীতির সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে এমন সব দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে কালোটাকা সাদা করাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। কালোটাকা সাদা করতে সরকার বিশেষ সুবিধা দিলে যে ব্যক্তিরা নিয়মিত কর ভ্যাট শুল্ক দিয়ে ব্যবসা করছেন তারা নিরুৎসাহিত হবেন।’

রাজস্ব খাতের বিশ্লেষক এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করতে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে দেশের অর্থনীতির মূল ধারায় তা যোগ হবে। এতে সরকারের অর্থসংকট কমবে। ঋণ নেওয়ার চাপ কমবে।’

স্বাধীনতার পর ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি কালোটাকা সাদা হয়। এই অর্থবছরের বাজেটে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা মূলধারার অর্থনীতিতে আনতে বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই অর্থবছরের বাজেটে বলা হয় ‘ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্নে অপ্রদর্শিত অর্থ জমি, বিল্ডিং, ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের প্রতি বর্গমিটারের ওপর নির্দিষ্ট হারে এবং নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, বন্ড বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের ওপর ১০ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।’

পরের বছর এ সুযোগ আর বাড়ানো হয়নি। বিশেষ সুবিধা দেওয়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ২০ হাজার ৬৫০ কোটি অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালোটাকা বৈধ বা সাদা করা হয়। এর মধ্যে নগদ টাকা সাদা করা হয়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাকি অর্থ বিনিয়োগ হয় জমি-ফ্ল্যাট কেনা এবং পুঁজিবাজারে। দেশের ইতিহাসে স্বাধীনতা-উত্তর কোনো এক অর্থ বছরে যা ছিল সর্বোচ্চ। এতে সে বছর রাজস্ব আয় হয় দুই হাজার ৬৪ কোটি টাকা।

প্রসঙ্গত, বিদ্যমান আয়কর আইনে একটি স্থায়ী ধারায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যেকোনো সময়ে নির্ধারিত করের (উচ্চ কর) পাশাপাশি জরিমানা হিসেবে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা (অপ্রদর্শিত অর্থ) প্রদর্শন করা যাবে। এটা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতে যত দিন এই ধারা বিলুপ্ত না হবে তত দিন থাকবে।’

এ ধারা অনুযায়ী উচ্চহারে কর দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ আছে। তবে রাজস্ব আইনের বিধান অনুযায়ী বিনিয়োগকারীর অর্থের উৎস নিয়ে এনবিআর কিছু না বললেও দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সরকারের যেকোনো সংস্থার জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে। আইনি জেরার মুখে পড়ার ভয়ে অনেকে কালোটাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করায় আগ্রহী হয় না।