desh-protikhon-logo-websiteফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: উৎপাদনহীন ও লোকসানি কোম্পানিগুলোর লাগাম টেনে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ কোম্পানিকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) পাঠিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কোম্পানিগুলো উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরুর যথাযথ উত্তর দিতে না পারলে তালিকাচ্যুতি (ডিলিস্টিং) করা হবে। তাই বিনিয়োগকারীদের এ কোম্পানিগুলোতে নতুন বিনিয়োগে সর্তক হওয়া উচিত।

জানা যায়, বিগত ৫ বছর বা এর বেশি সময় ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয় না, এমন ১২টি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুতির জন্য কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে ডিএসই। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর বর্তমান ও ভবিষ্যতের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ডিএসই হটকারী সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন। কারন নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর যাবতীয় তথ্য থাকে। কিন্তু একজন বিনিয়োগকারীর কাছে তা থাকে না।

কাজেই হঠাৎ করে কোনো কোম্পানিকে বাজার থেকে তালিকাচ্যুত করা হলে বিনিয়োগকারীরাই বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই হঠাৎ করেই কোনো কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত না করে সময় দেওয়া উচিত। কোনো কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার আগে তদন্ত করে ওই কোম্পানির খারাপ খবরগুলো বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে দেওয়া উচিত। এতে বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানি সম্পর্কে সচেতন হবে এবং পরবর্তীতে তালিকাচ্যুত করার পরে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায়ভার কারও ওপর বর্তাবে না বলে বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ দেয় না এ কোম্পানিগুলোকে শুধু ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে পাঠিয়ে দিলে কিংবা ওভার দ্য কাউন্টার মার্কেটে (ওটিসি) দিয়ে দিলে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা হয় না। কোম্পানিগুলোকে তালিকাচ্যুত করলেও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা হয় না। তাই যে কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরে উত্পাদনে আসতে পারছে না কিংবা মুনাফা করতে পারছে না তাদের মালিকানা পরিবর্তন করা যেতে পারে। যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের কাছে সেসব কোম্পানির মালিকানা দিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে ফের উত্পাদনমুখী ও মুনাফামুখী করা যেতে পারে।

আর সরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে কীভাবে সেগুলোকে লাভজনক করা যায় তা বিবেচনা করা দরকার। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষাকারী হিসেবে বিএসইসিকেই দায়িত্ব নিয়ে এ কাজ করতে হবে। স্টক এক্সচেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে এ কোম্পানিগুলোকে উত্পাদনশীল করতে পারলে বাজারের জন্য তা বড় ধরনের ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ বলেন, কোনো কোম্পানি মুনাফা করতে না পারলে কিংবা তাদের উত্পাদন বন্ধ হয়ে গেলে বিএসইসি বা স্টক এক্সচেঞ্জ তাদেরকে ‘জেড’ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়। কখনও কখনও কোম্পানিগুলোকে ওটিসিতে পাঠিয়ে দেয়। এতে কোম্পানির কোনো সমস্যা হয় না। বরং এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারহোল্ডারদের সমস্যা হয়। অথচ কোম্পানিগুলোর পরিচালকরা ঠিকই বছরের পর বছর ধরে বেতন-ভাতা নিয়ে যান।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। তেমনি কোম্পানিগুলোর পর্ষদ পুনর্গঠন করা যেতে পারে বলে তিনি মনে করেন। তেমনি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিএসইসি আইনগত ক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তেমনি প্রয়োজনে তারা আদালতেও যেতে পারে বলে জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মো. সালাহ উদ্দিন চৌধুরী, এফসিএ দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১৩টি কোম্পানি নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই দুটি কোম্পানিকে বাজার থেকে তালিকাচ্যুত করা হয়েছে। যে ১৩টি কোম্পানি নিয়ে বর্তমানে কথা হচ্ছে তার মধ্যে কয়েকটি কোম্পানির ৪৯ শতাংশের মতো শেয়ার সরকারের কাছে রয়েছে এবং কিছু নামকরা গ্রুপের কোম্পানিও আছে। এসব কোম্পানির গত পাঁচ বছরের কর্মক্ষমতা নেতিবাচক পর্যায়ে চলে যাওয়াতে তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে কী কারণে এমন হচ্ছে।

তাছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দেশনা প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোম্পানিগুলোর নিয়মিত এজিএম করা উচিত এবং প্রফিট অনুযায়ী শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেওয়া সবার কাছেই প্রত্যাশিত।

কারণ শেয়ারহোল্ডাররা বাজারে আসেই মুনাফার আশায়। তারা যদি এখান থেকে কোনো মুনাফাই না পায় তাহলে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে লাভ কি? তাছাড়া এ কোম্পানিগুলোর আইপিওতে আসার আগে অবশ্যই আর্থিক অবস্থান ভালো ছিল। যার কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চিন্তা করেছে বাজারে আসার মতো সামর্থ্য তাদের আছে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এসে তারা বুঝতে পারল আসলে তাদের কর্মক্ষমতা ভালো নয়।

যে কারণে নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের বাজার থেকে তালিকাচ্যুত বা পুনর্বিবেচনার কথা ভাবছে। তাছাড়া বাজারে এমন কাউকে রাখা উচিত নয়, যারা শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ। কাজেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার এ সিদ্ধান্ত যথাযথ ও সময়োপযোগী হয়েছে। তাদের এ কাজগুলো আরও আগে থেকেই করা উচিত ছিল।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা জানান,  ‘তালিকাচ্যুতি করা তো সমাধান নয়। তাছাড়া তালিকাচ্যুতি করার কিছু প্রক্রিয়া আছে, আমার মনে হয় তা পালন করা হয়নি। তালিকাচ্যুতি হওয়ার কারণে কোম্পানি দুটি ট্রেড হচ্ছে না। এতে বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

শেলটেক ব্রোকারেজ লিমিটেডের পরিচালক মো. মঈনউদ্দিন বলেন, যখন পুঁজিবাজার থেকে একটি কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করা হয় তখন ওই কোম্পানির সঙ্গে কিছু শেয়ারহোল্ডার কিন্তু জড়িত থাকে। কথা হচ্ছে শেয়ারহোল্ডাররা যখন বিনিয়োগ করে তখন তার অধিকার আছে যে কোনো শেয়ারে, যে কোনো দরে বিনিয়োগ করার। এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে অবশ্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে যে কোনো কোম্পানির সব তথ্য থাকে।  তাছাড়া তারা চাইলেই যে কোনো কোম্পানিকে চিঠি দিয়ে তাদের তথ্যগুলো জানতে পারে। এ কাজ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন দুজনই করতে পারে।

আর স্টক এক্সচেঞ্জের কাজ হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের সচেতন করা। কোনো কোম্পানি গত চার-পাঁচ বছর যাবৎ উৎপাদন বন্ধ। কোনো কোম্পানি চার-পাঁচ বছর যাবৎ ডিভিডেন্ড দিচ্ছে না এবং ওই কোম্পানির মালিকদের কর্মকাণ্ড স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে থাকে। কিন্তু একজন বিনিয়োগকারীর কাছে তা থাকে না।

কাজেই হঠাৎ করে কোনো কোম্পানিকে বাজার থেকে তালিকাচ্যুত করা হলে বিনিয়োগকারীরা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাই হঠাৎ করেই কোনো কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত না করে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা উচিত। কোনো কোম্পানিকে তালিকাচ্যুত করার আগে তদন্ত করে ওই কোম্পানির খারাপ খবরগুলো বিনিয়োগকারীদের জানিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে গিয়ে তাকে তালিকাচ্যুত করা উচিত। এতে বিনিয়োগকারীরা ওই কোম্পানি সম্পর্কে সচেতন হবে এবং পরবর্তীতে তালিকাচ্যুত করার পরে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার দায়ভার কারও ওপর বর্তাবে না। বিষয়টি নিয়ন্ত্রক সংস্থার গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা দরকার।