আবদুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: টানা দরপতনে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বাড়ছে। ২০১০ সালের পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন সময় পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দিলেও বার বার দরপতনের বৃত্তে ঘূর্ণায়মান। বর্তমান কমিশন আসার পর বাজার কিছুটা স্থিতিশীলতার আভাস দিলেও তা বেশি দিন টিকেনি। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোকসান কমার বদলে বাড়ছে।

এছাড়া মন্দা পুঁজিবাজারে বড় কোম্পানির আইপিও অনুমোদন ও গ্রুপভিত্তিক লেনদেনের কারণে কিছুদিন আগে আশা দেখালেও এখন ধুঁকছে। নতুন বিনিয়োগ আনতে বিদেশে রোড শোও আকৃষ্ট করতে পারেনি ক্রেতাদের। উল্টো দেশের বাইরে বাংলাদেশের ব্রান্ডিংয়ের নামে রোড শো চলাকালীন বিদেশীরা শেয়ার বিক্রি বাড়িয়েছেন।

• দুই কার্যদিবসে ২৭২ পয়েন্ট সূচক উধাও
• পুঁজি নিয়ে দু:শ্চিস্তায় বিনিয়োগকারীরা, বাড়ছে ফোর্স সেল আতঙ্ক
• বিনিয়োগকারীদের অহেতুক আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ

তেমনি উচ্চ দরে শেয়ার কিনে প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা ভুগছেন। এছাড়া গত দেড় বছরে তিনটি ব্রোকারেজ হাউস থেকে টাকা উধাও হওয়া এবং শেয়ার বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া মর্ডান সিকিউরিটিজ থেকে ৭ কোটি বিনিয়োগকারীরা উধাও হওয়া নিয়ে শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা। ফলে সবমিলে পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা বাড়ছে। এদিকে নতুন করে মূলত তিনটি কারণে পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণ চলছে।

এর মধ্যে প্রথমত, পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের ঋণাত্মক ঋণ হিসাব সমন্বয়ে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্দেশনা। বিএসইসি সম্প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ঋণাত্মক ঋণ হিসাবকে শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ আগামী বছরটি যখন শুরু হবে, তখন যাতে পুঁজিবাজারের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণাত্মক ঋণ হিসাব না থাকে। যদি এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তবে সেটি দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের জন্যই মঙ্গলজনক হলে বর্তমান বাজারের জন্য ভাল রক্ষণ নয়।

কারণ, বছরের পর বছর এ ধরনের হিসাবগুলোকে জিইয়ে রেখে সেগুলোর অপব্যবহার করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। শেয়ারবাজারে অনাদায়ি ঋণাত্মক ঋণ হিসাবগুলোর বেশির ভাগই তৈরি হয়েছিল ২০১০ সালের পুঁজিবাজার ধসের পর। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকে ওই সময় নিয়ম না মেনে শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীদের সীমার বেশি ঋণ দিয়েছিল। বাজারে ধস নামার পর সেসব ঋণ আর আদায় হয়নি। তাতে বিনিয়োগকারীরা যেমন নিজের পুঁজি হারান, তেমনি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া ঋণও আটকে যায়।

অন্যটি দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। ইউক্রেনে রুশ হামলার জেরে বিধ্বস্ত দেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। রাশিয়ার বোমা হামলায় যেমন আতঙ্কিত ইউক্রেনের মানুষ, তেমনি সূচকের ফ্রি ফল বা বাধাহীন পতনে আতঙ্কিত এ দেশের বিনিয়োগকারীরাও। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরুর পর পার্শ্ববর্তী দেশগুলো পুঁজিবাজারে তেমন প্রভাব না পড়লেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তৃতীয়ত, পুঁজিবাজারে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারমূল্যেই বিনিয়োগসীমার প্রজ্ঞাপন। মুলত পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিনিয়োগকারিদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল ‘ক্রয়মূল্যে বিনিয়োগসীমা’ নির্ধারণ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে ছিল বাজার মুল্যে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে নির্দেশনা দিয়েছে তা বাজারের জন্য সম্পূর্ণ নেতিবাচক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনার ফলে পুঁজিবাজারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সংকুচিত হবে।

এদিকে সবমিলিয়ে নানা ইস্যুতে পুঁজিবাজারে রক্তক্ষরণে দুই কার্যদিবসে নতুন করে ২৭২ পয়েন্ট সূচক উধাও। তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের সঙ্গে এক বড় দরপতনের যৌক্তিকতা খুজেঁ পাচ্ছেন না বাজার সংশ্লিষ্টরা। বিনিয়োগকারীদের অযৌক্তিক ভয় ও আতঙ্কের কারনে এই পতন হচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। তাছাড়া রাশিয়ার আক্রমনে ইউক্রেনবাসী যতটা আতঙ্কিত, তার চেয়েও যেনো বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা বেশি।

যাতে পুঁজিবাজারে হচ্ছে বড় পতন। যে পতনকে স্বাভাবিক মনে করছেন না বাজার সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ওই যুদ্ধের প্রভাব কতটা বাংলাদেশে পড়বে এবং তার মাত্রা পুঁজিবাজারে কতটুকু হবে, তা অনুধাবনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে অযথা আতঙ্কিত হয়ে নিজের কষ্টলব্ধ অর্থকে শেষ না করে দেওয়ার আহবান করেছেন।

অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারী প্রভাষক কাজী হোসাইন আলী বলেন, বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবটা কাজ করছে। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধের কিছু প্রভাব বিশ্বে পড়লেও বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত এর থেকে নিরাপদে আছে। আশা করা যাচ্ছে যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী হবে না। ইউক্রেন আলোচনা প্রত্যাখ্যান করলেও বিশ্ব শান্তির জন্য তারা শীঘ্রই আলোচনায় ফিরবে। কাজেই বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত হতাশা না হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

এদিকে সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন শুরুর প্রথম ১০ মিনিটের মধ্যেই ১০০ পয়েন্টের বেশি কমে গেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স। আর দিন শেষে সূচকটি ১৬৩ পয়েন্ট বা প্রায় আড়াই শতাংশ কমে নেমে এসেছে ৬ হাজার ৬৭৬ পয়েন্টে। এটি গত দুই মাসের মধ্যে ডিএসইএক্স সূচকের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ ২৭ ডিসেম্বর ডিএসইএক্স সূচকটি সর্বনিম্ন ৬ হাজার ৬৬৯ পয়েন্টে ছিল।

গত বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর খবরে ওই দিন ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছিল ১০৯ পয়েন্ট। বৃহস্পতিবার যুদ্ধের খবরে বিশ্বের বড় সব শেয়ারবাজারেও বড় ধরনের দরপতন ঘটে। তবে গত দুই দিনে বিশ্ব পুঁজিবাজার বড় ধরনের পতনের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে। কিন্তু যুদ্ধের রেশে বড় পতনের সেই ধাক্কা কাটাতে পারেনি বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। ফলে দ্বিতীয় দিনের মতো আজও সূচকের বড় পতন দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। দুই দিনে ঢাকার বাজারের প্রধান সূচকটি কমেছে ২৭২ পয়েন্ট।

বাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহম্মেদ বলেন, বিশ্ব পুঁজিবাজার যখন যুদ্ধের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে, তখন দেশের পুঁজিবাজারে সূচকের এ ধরনের পতনের কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এই পক্ষটির শঙ্কা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী যুদ্ধের ভীতিকে কাজে লাগিয়ে বড় ধরনের পতন ঘটিয়ে কম দামে শেয়ার কিনে নিতে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। সেই গুজবের ফাঁদে পা দিচ্ছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। আতঙ্কিত হয়ে তাঁরা লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

আজ ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১৬৩.২৯ পয়েন্ট বা ২.৩৮ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৬৭৬.১৪ পয়েন্টে। ডিএসইর অপর সূচকগুলোর মধ্যে শরিয়াহ সূচক ৩০.৫৭ পয়েন্ট বা ২.০৭ শতাংশ এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৪৭.০৭ পয়েন্ট বা ১.৮৭ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৪৫.১৪ পয়েন্টে এবং দুই হাজার ৪৬৭.৯০ পয়েন্টে। ডিএসইতে আজ টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে ৯১৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট। যা আগের দিন থেকে ১৩৪ কোটি টাকা কম। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকার।

ডিএসইতে আজ ৩৭৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০টির বা ২.৭৪ শতাংশের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে। দর কমেছে ৩৬৫টির বা ৯৬.৩০ শতাংশের এবং ৪টি বা ১.০৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর অপরিবর্তিত রয়েছে।

অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এদিন ৫০৬.১৮ পয়েন্ট বা ২.৫৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৮৫.৩৬ পয়েন্টে। এদিন সিএসইতে হাত বদল হওয়া ৩০৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ৮টির, কমেছে ২৮৩টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৩টির দর। আজ সিএসইতে ৩৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে।