times_of_india_logoঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে ‘যুদ্ধবাজ বেগম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ভারতের দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ একটি প্রতিবেদনে লিখেছে, এই দুই নেতার মধ্যকার ‘বিষাক্ত’ সম্পর্ক দেশকে আরো একবার খাদের কিনারে নিয়ে গেছে।

দৈনিকটি এ-ও লিখেছে, দুই দশক আগে যখন তারা রাজনীতিতে প্রথমবারের মতো সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং নিজ নিজ দলের কাণ্ডারি হয়ে দেশনেত্রীরূপে জনগণ ও দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এক নতুন দ্বার উন্মুক্ত হতে শুরু করেছিল।

‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ লিখেছে, রোববার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন কার্যত একদলীয় নির্বাচন। তাই ক্ষমতাসীন দলের প্রধান শেখ হাসিনাই যে আবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হচ্ছেন, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।

এদিকে, নির্বাচন উপলক্ষে যে সময়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকার কথা, সে সময়ে প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া নিজ বাসভবনে একরকম গৃহবন্দীই হয়ে আছেন। দশম নির্বাচন শুধু ‘প্রহসনের নির্বাচন’-  এমন অভিযোগ করে বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার পর থেকেই তার গুলশানের বাসায় গৃহবন্দী।

নির্বাচনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা ছিল, এই দুই নারীনেত্রী নিজেদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষ সরিয়ে রেখে দেশ ও জনগণের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত হয়তো কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবেন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটিতে এত বেশি রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও অভ্যুত্থান হয়েছে যে, তারপর এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আবার এ রকম কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, তা তারা চাইবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছিল।

কিন্তু মধ্যস্থতা করার হাজারো প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে এই দুই নারী শেষ মুহূর্তেও যার যার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন; নিজেদের দাবি থেকে তারা কেউই পিছপা হননি। সব মিলিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমঝোতা তো দূরের কথা, বরং পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

রোববারের নির্বাচনকে ‘স্রেফ একটি ওয়ার্ম-আপ ম্যাচ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ঢাকার একজন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “দুই বেগমের মধ্যকার যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে দেশটি যে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, এই নির্বাচন সেটিরই একটি পূর্বাভাস মাত্র। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ খাদের কিনারে পৌঁছে গেল।”

গত অক্টোবরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা আসার পর থেকেই বিরোধীদলীয় নেতার দাবি ছিল একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে নির্বাচনকালীন সরকার থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সরে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু দেশটির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বিরোধী দলকে দায়ী করে বিরোধী দলের নেতার এই আহ্বানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করার পরিবর্তে দেশব্যাপী ধারাবাহিকভাবে লাগাতার হরতাল ও অবরোধের মতো সহিংস কর্মসূচি দেয়ার জন্য বিএনপির দিকে ক্রমাগত অভিযোগের আঙুল তুলে গেছেন তিনি।

পাশাপাশি দলটির নেতা খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেয়ার আহ্বানও জানিয়ে গেছেন। সে আহ্বান আবার প্রত্যাখ্যান করেছেন খালেদা জিয়া নিজেও।

এই দুই নেতার অন্তর্দ্বন্দ্ব যে আসলে কতটা প্রকট, তা প্রথমবারের মতো সামনে আসে দুই নেত্রীর ফোনালাপের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পরে। গত ১৫ বছরে এটাই ছিল দুই নেত্রীর মধ্যে একমাত্র সরাসরি কথোপকথন।

অনেক নাটকীয়তার পর তারা দুজন ফোনে কথা বলেছিলেন গত অক্টোবর মাসে। কথোপকথনের শুরুতে প্রাথমিকভাবে দুই নেত্রী কিছু কুশল বিনিময় করলেও কিছুক্ষণ পর থেকে দুজনই একে-অপরের প্রতি অশালীন মন্তব্য করতে শুরু করেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন খালেদা জিয়া- এই অভিযোগ করে বারবার নিজের অবস্থানের ব্যাপারে দৃঢ়তা প্রকাশ করছিলেন হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। প্রতিবছরের  এই দিনে উদ্দেশ্যমূলকভাবে খালেদা জিয়া উৎসবমুখরভাবে নিজের জন্মদিন পালন করেন বলেও অভিযোগ করেন হাসিনা।  ৬৬ বছর বয়স্ক হাসিনা এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়ার প্রতি প্রশ্ন ছুড়ে দেন,  “কেন আপনি ১৫ আগস্ট কেক কাটেন?” উত্তরে ৬৯ বছর বয়স্ক খালেদা জিয়া বলেন, “এই দিনে কি কারো জন্ম  নেয়ার অধিকার নেই?”

তাদের মধ্যকার এই শত্রুতা আরো একবার জনগণের সামনে এসেছিল ২০০৭ সালে।  সে সময়ও তারা নির্বাচনের বিষয়ে সমঝোতায় আসতে পারেননি। ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে জরুরি অবস্থা জারি করে একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেছিল।

বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগে এই দুই নেত্রীকেই তখন গ্রেফতার করে প্রায় ছয় মাস কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। তারপর মুক্তি পেয়ে তারা ২০০৮ সালে আবারও নির্বাচনে অংশ নেন এবং শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ বিশাল ব্যবধানে জয় লাভ করে।

প্রসঙ্গত, হাসিনা-খালেদার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ১৯৯০ সালেই শুধু তারা একসঙ্গে কাজ করতে পেরেছিলেন। তাদের একতাবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমেই সে সময়ের আরেক সামরিক সরকার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পদচ্যুত করানো সম্ভব হয়েছিল।

কিন্তু তার পরই দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন উপলক্ষে এই দুই নারী প্রতিপক্ষরূপে আবির্ভূত হন। সে সময় থেকেই তারা একে-অপরকে জনসম্মুখেই ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করতে শুরু করেন।

সে সময়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশের প্রথম নির্বাচিত সরকার গঠন করে বিএনপি। তারপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে নানা রকম অনিয়ম আর ভোট কারচুপির মাধ্যমে আবার খালেদা জিয়া নির্বাচনে জয়ী হলে সরকার গঠনের মাত্র ৪৩ দিনের মাথায় হাসিনা শক্ত প্রতিরোধের মাধ্যমে খালেদাকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে বাধ্য করেন। হাসিনার প্রতিরোধের মুখেই তখন প্রথমবারের মতো দেশটিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পদ্ধতি সংবিধানে যোগ করা হয়।  একই অবস্থা হয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনেও।  ওই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার পরিবর্তন করে ক্ষমতায় এসেছিল বিএনপি।

এই দুই নেত্রীর সম্পর্কের আরো অবনতি হয় যখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে একটি জনসমাবেশে প্রকাশ্যে হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করা হয় গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে। ওই ঘটনায় হাসিনা বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দলের ২০ জন নেতাকর্মীকে হারান তিনি। এই ঘটনার জন্যও তার পর থেকে ক্রমাগত খালেদাকেই দুষে গেছেন খাসিনা।

ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় এই দুই নারী ক্রমাগত এত বছর লড়াই চালিয়ে এলেও তাদের দুজনেরই রাজনীতিতে আসার পেছনে আছে করুণ ইতিহাস।

১৯৮১ সালে দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে যখন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হত্যা করা হয়, তখন দুই তরুণের মা খালেদা জিয়া ছিলেন নিতান্তই একজন গৃহিণী। আর হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হাতে নিয়েছিলেন, কারণ তার বাবা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা সপরিবারে হত্যা করেছিলেন।  সে সময় হাসিনা বেঁচে গিয়েছিলেন দেশের বাইরে থাকায়।  পরে জার্মানি থেকে ফিরে এসে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নেন।

মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক নেতাই নারী। আর ‘বেগম’ হলো মুসলমান নারীদের জন্য একটি সম্মানজনক পদবি। অধিকাংশ নাগরিক এবং রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক  ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সম্মানজনক পদবিতে ভূষিত হওয়ার পরও এই দুই নারী দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দিন দিন বিষাক্ত করে তুলছেন। তাই তাদের সম্মানজনক কোনো পদবিতে ভূষিত করার বদলে বরং উল্টোটাই করা উচিত।

শনিবার দেশটির অন্যতম প্রধান সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকার সম্পাদকীয়কে সম্পাদক লিখেছিলেন, সময় এসেছে। এই দুই নেতারই উচিত বিদায় নেয়ার জন্য একটি সম্মানজনক পথ বেছে নেয়া।