job_14085

এইচ কে জনি : রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতির কারণে লোকসানের বৃত্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাগুলো। বছরের পর বছর ধরে লোকসানের থাকার কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থাগুলোর রাষ্ট্রীয় মালিকানা ছেড়ে দেয়ার দাবি উঠছে। কারণ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীণ সংস্থাগুলো রাষ্ট্রের উপকারে আসার বদলে উল্টো রাষ্ট্রের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৮ বছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ১১ সংস্থায় সরকারকে ১১ হাজার ৩৯৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে সরকারকে আর লোকসানের বোঝা বইতে হবে না বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকটি সংস্থায় ভর্তুকির পরিমাণ কম লাগলেও অধিকাংশ সংস্থাগুলোতে সরকারকে বড় ধরনের অর্থ সংস্থান করতে হয়েছে। এ সংস্থাগুলোতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে (সংশোধিত) সবচেয়ে বেশী পরিমাণ অর্থ সংস্থান করতে হয়েছে। এ সময়ে সরকারকে ২ হাজার ১৮৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। এছাড়া ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১ হাজার ১৫৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ হাজার ১০১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৪৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৮০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ১ হাজার ২৯১ কোটি ৫ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১ হাজার ৩২৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে (সাময়িক) ১ হাজার ৭০৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার।

অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১১টি সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডকে (বিডব্লিউডিবি) সর্বাধিক ৫ হাজার ২৮০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৬৪৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ৫৩১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৬৪০ কোটি ২৯ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬৭৭ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭০৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৪৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে (সাময়িক) ৮৯১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে (সংশোধিত) ১ হাজার ৮৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। এছাড়া অন্যান্য যেসব সংস্থাকে উল্লেখযোগ্যহারে ভর্তুকি দিতে হয়েছে, সেগুলো হলোÑ বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) ৫৯৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ১ হাজার ৪৩১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিএসসিআইসি) ৬২১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড (বিএসবি) ১০৪ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ১৩৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (বিএডিসি) ১ হাজার ৯৪৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যে কোনো সংস্থা সরকারি মালিকানায় থাকলে তাতে দুর্নীতি হবে -এটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক দেশে। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ব্যবস্থাপনা পরিষদের পরিবর্তন হবার কারণে ওই সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা বজায় থাকে না। শুরু হয় দুর্নীতি আর লুটপাট। এতে করে সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারায়, পাশাপাশি সেই সংস্থার লোকসানের বোঝা সরকারকেই বহন করতে হয়। পরিণতিতে সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা খাতে এবং দেশের কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় না।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সে দেশগুলোতে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কিছু সংস্থা শুধু সরকার মালিকানায় থাকে। যেগুলো কোনো বাণিজ্যিক বা মুনাফাভোগী সংস্থা নয়। ওই দেশগুলোর সবকিছুই বেসরকারি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত। তারা পৃথিবীর অন্যতম দেশ আমেরিকার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ওই দেশে একমাত্র পোস্ট অফিস ছাড়া আর কোনো বাণিজ্যিক সংস্থা সরকারি মালিকানায় নেই। সেখানে বেশিরভাগ সংস্থা বেসরকারি মালিকানাধীন হওয়ায় সেখানে দুর্নীতির ছোয়া লাগেনি। কারণ বেসরকারি মালিকানাধীন সংস্থাগুলো হাতেগুনা কয়েকজন পরিচালক দ্বারা পরিচালিত হয় বলে স্বচ্ছতা থাকে। এছাড়া তাদের নিজ স্বার্থে মুনাফা লাভের জন্য সংস্থা সংশ্লিষ্ট গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। যে কারণে সংস্থাটির সার্বিক অগ্রগতি সাধিত হয়। এতে করে সরকার একদিকে বড় অঙ্কের রাজস্ব পায়, অন্যদিকে এসব সংস্থায়র লোকসানের বোঝা সরকারকে বহন করতে হয় না। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নসহ সবদিক বিবেচনা করে লোকসানী এসব সংস্থাকে আর ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে না রেখে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়ার পক্ষে মত দেন তারা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলো সবসময়ই দুর্নীতিতে ছেয়ে থাকে। আর সে কারণে তারা বছরের পর বছর লোকসান দিয়ে থাকে। বছর শেষে সেই লোকসানের বোঝা সরকার তথা জনগণকে বয়ে বেড়াতে হয়। কাজেই এসব সংস্থাগুলোকে সরকারি মালিকানায় না রেখে যত দ্রুত সম্ভব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে। এতে সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়বে। যার ফলশ্রুতিতে একদিকে সরকারকে বাড়তি লোকসানের বোঝা বহন করতে হবে না। অন্যদিকে, এসব সংস্থা থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আয় হবে। এসব সংস্থাগুলোকে ভর্তুকি টিকিয়ে রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করেন তিনি।