dse-up-dowenদেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংক ও আর্থিক খাতের দখলে পুঁজিবাজার, তবে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না! এর ফলে বাজারের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছেন বিনিয়োগকারীরা। দিন যতই যাচ্ছে বাজারের অবস্থা ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য বিনিয়োগকারীরা নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। বর্তমানে পুঁজিবাজারে লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। গত তিন মাস ধরে এ অবস্থা। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোট লেনদেনের ৫০ শতাংশই রয়েছে খাত দুটির দখলে।

ডিএসইর খাতভিত্তিক কোম্পানির তালিকা থেকে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ২২টি খাতে বিভক্ত। এর মধ্যে লেনদেনে হয় ২০টি খাতের। এসব খাতে কোম্পানি আছে ৩৩৮টি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কোম্পানির সংখ্যা ৫৩টি। যা লেনদেন হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ১৫ শতাংশের সমান। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ কোম্পানির দখলে রয়েছে মোট লেনদেনের ৫০ শতাংশ।

ডিএসইর মাসভিত্তিক লেনদেনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শেষ তিন মাসের মধ্যে সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে মোট লেনদেনের ৪০ শতাংশের ওপরে ছিল ব্যাংক খাত। এ খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৩০টি। সে হিসাবে মোট লেনদেনের প্রায় অর্ধেক ছিল মাত্র নয় শতাংশ কোম্পানির দখলে। তবে নভেম্বরে এসে ব্যাংক খাতের লেনদেন কিছুটা কমে। ওই মাসে মোট লেনদেনের ৩৩ শতাংশ ছিল ব্যাংক খাতের।

অপরদিকে আর্থিক খাতের কোম্পানির সংখ্যা ২৩টি। নভেম্বর মাসের মোট লেনদেনের ১২ শতাংশ হয়েছে এ খাতে। আগের মাস অক্টোবরে মোট লেনদেনের সাড়ে ১১ শতাংশ ছিল আর্থিক খাতের। তবে সেপ্টেম্বরে আর্থিক খাতের অবদান ছিল ১০ শতাংশের নিচে।

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরে সার্বিক শেয়ারবাজার বেশ ভালো অবস্থানে ছিল। নতুন নতুন বিনিয়োগকারীও বাজারে প্রবেশ করে। বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কিছুটা বাড়ে। যে কারণে লেনদেনের পরিমাণও বাড়ে।

তিনি বলেন, ব্যাংকের শেয়ার তুলনামূলক ফান্ডামেন্টাল। ব্যাংকের আর্থিক হিসাবও অন্য খাতের তুলনায় স্বচ্ছ। এছাড়া দীর্ঘ মন্দার কারণে অনেক ব্যাংকের শেয়ারের দাম বেশ কমে যায়। যে কারণে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ে আগ্রহী হন। আবার দাম বাড়ার কারণে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে দেন। এ কারণে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন বাড়ে। ব্যাংক খাতের লেনদেন বাড়ার প্রভাবে আর্থিক খাতের লেনদেনও বাড়ে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালে শেয়ারবাজারের উত্থানে বড় ভূমিকা রাখে ব্যাংক খাত। সে সময় শেয়ারবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচিত হতো শেয়ারবাজার। কিন্তু মোট লেনদেনে ব্যাংক খাতের অবদান এতো বেশি ছিল না। ২০১০ সালে ডিএসইতে মোট লেনদেনের প্রায় ৩০ শতাংশ ছিল ব্যাংক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের।

তবে মহাধসের পর অনেকটা ধারাবাহিকভাবে এ খাতের অবদান কমে যায়। কমতে কমতে ২০১৬ সালে এসে একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। মোট লেনদেনে ব্যাংক খাতের অবদান নেমে যায় ১০ শতাংশের নিচে।

ব্যাংক খাতের এমন দুরবস্থায় সার্বিক শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর ধরে মন্দাভাব থাকে শেয়াবাজারে। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে শেয়াবাজারে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়। এক্ষেতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে ব্যাংক খাত।

ব্যাংক খাতের লেনদেন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মূল্যসূচক ও লেনদেনের পরিমাণ। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ডিএসইতে ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন হয় পাঁচ হাজার আট কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। পরের মাস ফেব্রুয়ারিজুড়ে লেনদেন হয় দুই হাজার ৩৬২ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ।

মার্চে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় চার হাজার ৭১৬ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এপ্রিলে লেনদেন কমে দাঁড়ায় দুই হাজার ৮৪৭ কোটি টাকায়, যা মোট লেনদেনের ১৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। মে মাসে তা আরো কমে এক হাজার ৬৮৭ কোটি টাকায় নেমে আসে, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। জুন মাসেও ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন কিছুটা কমে এক হাজার ৬৮৬ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, যা মাসটির মোট লেনদেনের ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।

তবে জুলাই মাস থেকে আবার বাড়তে থাকে ব্যাংকের লেনদেন। মাসের ব্যবধানে জুলাইতে এসে ব্যাংক খাতের কোম্পানির শেয়ার লেনদেন প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয় তিন হাজার ৩২৪ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরের তিন মাস আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ব্যাংকের দাপট আরো বাড়ে।

আগস্টজুড়ে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় পাঁচ হাজার ৬১ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকের লেনদেন আরো বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ১৩৬ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৪০ দশমিক ৮০ শতাংশ। অক্টোবরজুড়ে ব্যাংকের লেনদেন হয় ছয় হাজার ৪১৭ কোটি টাকা, যা ডিএসইর মোট লেনদেনের ৪০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সর্বশেষ নভেম্বর মাসে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয় ছয় হাজার ৭৬ কোটি টাকা, যা মোট লেনদেনের ৩৩ শতাংশ।

নভেম্বর মাসে ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন কমলেও সার্বিক লেনদেন আগের মাসের তুলনায় বাড়ে। নভেম্বরজুড়ে ডিএসইতে লেনদেন হয় ১৮ হাজার ৪২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আগের মাস অক্টোবরে বাজারটিতে মোট লেনদেন হয় ১৫ হাজার ৬৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে ডিএসইতে লেনদেন বাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ওপরে।

ডিএসইর মাসভিত্তিক লেনদেনের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসের মতো নভেম্বর মাসেও ডিএসইতে লেনদেনের শীর্ষস্থান দখল করে ব্যাংক খাত। তবে আর্থিক খাতকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে প্রকৌশল খাত। মোট লেনদেনের মধ্যে খাতটির অংশ ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। মোট লেনদেনের ১২ দশমিক ১৩ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আর্থিক খাত।

নভেম্বর মাসে তৃতীয় স্থানে থাকা ওষুধ খাতের লেনদেনের অংশ নয় দশমিক ৫৪ শতাংশ। বস্ত্র খাতের অবদান সাত দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ছয় দশমিক শূন্য চার শতাংশ নিয়ে এরপরই রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত।

বাকি সবকটি খাতের অবদান পাঁচ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে শুধু খাদ্য খাতের অবদান ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। বাকি খাতগুলোর এককভাবে অবদান দুই শতাংশ বা তার নিচে।