দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার লক্ষে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) নয়া পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে তারল্য সংকট বিরাজ করায় আইসিবি এ নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। আগামী বাজেটে তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়ে সরকারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে আইসিবি। পর্যায়ক্রমে এর আকার আরও বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে।

কারন বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে বিনিয়োগের উত্তম সময়। দিন দিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে। নতুন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়লেও অস্থিতিশীল বাজার থাকায় লেনদেন তেমন একটা বাড়ছে না।

এছাড়া নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে আইসিবি নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। টানা অস্থিতিশীল বাজার থেকে উত্তরণের পাশাপাশি চলমান তারল্য ও আস্থার সংকট দূর করতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু নতুন কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে আইসিবি ।

সুত্রে জানায়, দেশের পুঁজিবাজারকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোরালো ভুমিকা রাখার মতো একটি স্টক এক্সচেঞ্জে উন্নতি করতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরুর উপর গুরুত্বারোপ করা হবে। এদিকে বর্তমান সরকারের আন্তরিক উদ্যোগের ফলে গত ১০ বছরে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন ও উন্নয়ন হয়েছে। এক্সচেঞ্জ ডিমিউচুয়ালাইশেন থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোয় বড় ধরনের সংস্কার করা হয়েছে।

ফলে আগের তুলনায় বাজারের ভিত্তি অনেকটাই শক্তিশালী হয়েছে। তবে পুঁজিবাজারে যখন পতন শুরু হয় তখন শেয়ার কেনা থেকে হাত গুটিয়ে নেন সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা। এতে বাজারে পতনের গতি আরও বাড়ে। এ সময়ে বেশি করে শেয়ার কিনে তা ঠেকানোর জন্য ‘মার্কেট সাপোর্ট ফান্ড’ গঠনের প্রস্তাব করেছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)।

রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, আগামী বাজেটে তহবিল গঠনের ঘোষণা দিয়ে সরকারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এর আকার আরও বাড়ানোর কথাও বলা হয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের জানুয়ারিতে হঠাৎ উল্লম্ফনের পর টানা আট সপ্তাহ পতনের ধারায় রয়েছে পুঁজিবাজার।

এ সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচকটি প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক নেমে এসেছে ৫৫০৫ পয়েন্টে। লেনদেন হাজার কোটি টাকা থেকে কমে নেমে এসেছে ৩৫২ কোটি টাকায়। এ প্রেক্ষাপটে পুঁজিবাজারের জন্য আর্থিক সহায়তা চেয়ে গত ১০ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

প্রস্তাবে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কাজী ছানাউল হক লিখেছেন, ‘পুঁজিবাজারে গতিশীলতা ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর আস্থা ধরে রাখার প্রয়োজনে মার্কেট সাপোর্ট প্রদানের জন্য সরকার র্কর্তৃক একটি মার্কেট সাপোর্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে, যা পুঁজিবাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী আইসিবি পর্যায়ক্রমে সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ হিসেবে ব্যবহার করবে। প্রাথমিকভাবে সরকার র্কর্তৃক পাঁচ হাজার কোটি টাকা ফান্ডের আকার ঘোষণাপূর্বক পর্যায়ক্রমে বছরভিত্তিক জাতীয় বাজেটে তহবিলের সংস্থান রাখা যেতে পারে।’

এ বিষয়ে আইসিবির এমডি কাজী ছানাউল হক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বাজার যখন পড়তে থাকে তখন বিনিয়োগ করার মতো কেউ থাকে না। ওই পরিস্থিতিতে বাড়তি অর্থ বিনিয়োগ না করলে বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পতনকালীন বিনিয়োগের জন্যই সরকারের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল চাওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এর আগে আইসিবিকে দুই হাজার কোটি টাকা বন্ড সুবিধা দিয়েছিল, তা দিয়ে পাঁচ-ছয় মাস ধরে আমরা বাজারে সাপোর্ট দিয়েছি। কিন্তু বন্ডের সুদহার অনেক বেশি। সরকারের কাছ থেকে তহবিল পেলে তা কম সুদে বিনিয়োগ করা সম্ভব হবে। আর বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকারের সহযোগিতাও প্রয়োজন।’

কাজী ছানাউল হক বলেন, ‘আগামী বাজেটে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হলে বাজারের সংকটময় মুহূর্তে তা কম সুদে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সরবরাহের মাধ্যমে বাজারে তারল্য সরবরাহ বাড়ানো হবে। পরে বাজার স্থিতিশীল হলে সেই অর্থ সুদাসলে নিয়ে সরকারকে পরিশোধ করা হবে। এতে বাজারে অস্বাভাবিক পতন রোধ করা সম্ভব হবে।’ গত বছরের মাঝামাঝিতে সরকারের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকার বন্ড পায় আইসিবি। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে গত ১৮ মার্চ পর্যন্ত এক হাজার ২৩৬ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে; অবশিষ্ট আছে ২৬৪ কোটি টাকা।

আইসিবির তথ্য মতে, গত ৬ নভেম্বর ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৫২০৪ পয়েন্ট। বন্ডের মাধ্যমে নেওয়া অর্থ বিনিয়োগের পর গত ২৪ জানুয়ারি সূচক বেড়ে ৫৯৫০ পয়েন্টে উন্নীত হয়। এরপর থেকেই বাজার নি¤œমুখী হতে শুরু করে। গত ১৯ মার্চ লেনদেন শেষে সূচক ৫৬০৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

সংস্থাটি বলছে, পুঁজিবাজারে আইসিবির মতো বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান না থাকায় শেয়ার বিক্রি করা অর্থ পুঁজিবাজার থেকে উত্তোলন করা সব সময় সম্ভব হয় না। ফলে ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তহবিল সংগ্রহ করে বাজারে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এ কারণে ২০১১ সালের ৩০ জুন আইসিবির টার্ম ডিপোজিটের স্থিতি ছিল ২ হাজার ২৭১ কোটি টাকা, যা গত ৩০ জুন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা। বেড়েছে সুদ ব্যয়ও।

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটির তথ্য মতে, ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত আইসিবির মেয়াদি আমানতে ক্রমযোজিত বৃদ্ধির হার বছরে ২১ শতাংশ। এ সময়ে মোট আয় বাড়ার ক্রমযোজিত হার ১৩ শতাংশ। পোর্টফোলিওর আয়ে ক্রমযোজিত বৃদ্ধির হার বছরে ১৫ শতাংশ হলেও সুদব্যয়ের ক্রমযোজিত বৃদ্ধির হার বছরে ২৪ শতাংশ। মেয়াদি আমানত বাড়ার কারণে করপোরেশনের সুদব্যয় বাড়ছে। স¤প্রতি পাওয়া দুই হাজার কোটি টাকার বন্ডে সুদহার ৯ শতাংশ।

এতে আগামী বছরগুলোতে সুদব্যয় আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বাড়তি ব্যয় মেটাতে নিজস্ব পোর্টফোলিওর মূলধনি মুনাফা ও লভ্যাংশ আয়ের ওপর নির্ভর করতে হবে। এতে বাজারে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও করছে আইসিবি। এরই মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আইসিবির নেওয়া ‘সিঙ্গেল পার্টি এক্সপোজার’ সীমার অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয় করতে তাগাদা দেওয়া শুরু হয়েছে।

তহবিল গঠনের প্রস্তাবে আইসিবি আরও বলেছে, বাজারে গতিশীলতা রাখার ক্ষেত্রে তহবিলের জোগান বা শেয়ার কেনা ও সিকিউরিটিজের সরবরাহ বা বিক্রির মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন। এ ছাড়া বাজারে মৌলভিত্তিসম্পন্ন বহুজাতিক কোম্পানিসহ অন্যান্য দেশীয় কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে আইসিবি চার হাজার ৪৩১ কোটি টাকার শেয়ার কেনে এবং বিক্রি করে তিন হাজার ৩৭৩ কোটি টাকার শেয়ার। একই অর্থবছরে বাজারমূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিও মূল্য ছিল ১০ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর সংস্থাটি ২ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার শেয়ার ক্রয় ও বিক্রি করে ২ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার শেয়ার।

একই অর্থবছরে বাজারমূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিও মূল্য ছিল ১০ হাজার ৭১ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরের ১৮ মার্চ পর্যন্ত আইসিবি ২ হাজার ২৬৯ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছে, বিক্রি করেছে এক হাজার ৭২৪ কোটি টাকার শেয়ার। বাজারমূল্যে আইসিবির পোর্টফোলিওর মূল্য ১১ হাজার ৩০ কোটি টাকা।