আমিনুল ইসলাম ও সাজিদ খান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে দরপতনে অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশের পুঁজিবাজার। একদিন কিছুটা আলোর মুখ দেখলেও অন্যদিন অস্বস্তিতে ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে পুঁজিবাজারের এরকম অস্থিতিশীল আচরনে সব মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু নতুন কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। আসন্ন বাজেটের পর অর্থমন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয় নির্দেশনা দেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে।

সুত্রে জানায়, দেশের পুঁজিবাজারকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে জোরালো ভুমিকা রাখার মতো একটি স্টক এক্সচেঞ্জে উন্নতি করতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরুর উপর গুরুত্বারোপ করা হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব দেওয়া হবে, যার নেতৃত্বে থাকবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

এছাড়া ভালো সিকিউরিটিজের যোগান ও সেগুলোর চাহিদা বাড়াতো পুঁজিবাজারে প্রাইভেট ইক্যুইটি ও ডেরিভেটিকস প্রচলনে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নতুন প্রডাক্ট চালু, বিভিন্ন টেকনিক্যাল অগ্রগতি, এসএমই বান্ধব প্লাটফর্ম গড়ে তোলাসহ একচেঞ্জের টেকসই উন্নয়নে কাজ শুরু করকে সরকার।

এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের সমন্বয়ে একটি যৌথ থিংক ট্যাংক গড়ে তোলা হবে। তারা পুঁজিবাজারকে মুলধন উত্তোলনের জন্য যথোপযুক্ত জায়গা হিসেবে তৈরি করে বাজারের গভীরতা বাড়াতো কাজ করবে। পুঁজিবাজারের অস্থিতিশীলতা উল্লেখ করে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাজেটের পর একটি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী পুঁজিবাজার গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে।

এদিকে গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জিতে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠনের পর এক মাসেরও বেশি সময় টানা বেড়েছে পুঁজিবাজার। তবে ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় দর সংশোধন। আর এই সংশোধন প্রলম্বিত হতে থাকলে এক পর্যায়ে প্রায় ৮০০ পয়েন্ট হারায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্বিক সূচক। চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও একই দশা। আতঙ্ক ছড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।

তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি, সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ আইসিবি তৎপর হয়। বৈঠকের পর বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদে দেন নির্ভয় বাণী। ফলে পুঁজিবাজারের এরকম পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিও বিপাকে পড়েছে। তাই পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতা ফেরানোই বর্তমান সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিচ্ছে সরকার। অতীতের মতো বড় শেয়ার কেলেঙ্কারি যাতে না ঘটে সেই কারণে বিদ্যমান আইন সংস্কারের পাশাপাশি পণ্যের বহুমুখীকরণে নজর দেয়া হচ্ছে। সা¤প্রতিক সময়ে টানা পতনে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা হিসেবে শর্টসেলসহ তিনটি নতুন আইনের খসড়াও ইতোমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে।

বতর্মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ওপর আস্থা রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমস্যা সমাধানে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া নির্দেশ দিয়েছেন।

অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামালও বলেছেন, পুঁজিবাজারের সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে। দ্রুতই তার সমাধান করা হবে। তিনিও পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতার জন্য সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

জানা গেছে, ২০১০ সালের ধসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএসইসিকে বিএসইসি ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন হয়। ২০১১ সালের ১৫ মে বিএসইসিতে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন। ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের কারণ অনুসন্ধানে খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির বিএসইসিকে ঢেলে সাজানোর পরামর্শের আলোকে এই নিয়োগ দেয়া হয়েছিল।

প্রথমবার ৩ বছরের জন্য খায়রুল হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়। যা শেষ হওয়ার আগেই পুনর্নিয়োগ পান তিনি। তবে এক্ষেত্রে তিনি ৪ বছরের জন্য পুনর্নিয়োগ পান। এরপরে গতবছরের ২৪ এপ্রিল তার ২ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর শেয়ারবাজার চাঙ্গাভাব ফিরে আসে। কিছুদিন পরই সূচকের নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়। টানা ১২ সপ্তাহ ধরে শেয়ারবাজারে দরপতন দেখা দেয়। অতীতের মতো শেখ হাসিনা আবার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। স¤প্রতি তিনি, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অর্থমন্ত্রণালয় এবং বিএসইসির সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করেছেন।

এর আগেও প্রধানমন্ত্রী শেয়ারবাজার নিয়ে কমিশনের সঙ্গে ৭টি সভা করেছেন। শেয়ারবাজার নিয়ে অস্থিরতা বাড়লেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এগিয়ে আসেন। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বর্তমান কমিশন বিগত ৮ বছরে ৭০টিরও বেশি সংস্কার করেছে।

গত ২০১০ সালে শেয়ারবাজারে ধসের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে ছিল প্লেসমেন্টে বাণিজ্যের নৈরাজ্য। যা এখন কমিয়ে আনা হয়েছে। সংস্কারে যেকোন মূল্যে লাখ লাখ মানুষের কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি বন্ধ করা হয়েছে। নতুন আইনে সর্বোচ্চ ১০০ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে প্লেসমেন্টে শেয়ার বিক্রি করা যায়। পরবর্তীতেও এটির সুযোগ নেন মার্কেট প্লেয়াররা।

একবার ১০০ জনের মধ্যে প্লেসমেন্ট বিক্রির পর ফের নতুন করে মূলধন উত্তোলনের অনুমোদন নেন কোম্পানিগুলো। যার কারণে নতুন করে এই মার্কেট নিয়ে অস্থিরতা তৈরি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা মূলধন উত্তোলনের ক্ষেত্রে কমিশনের অনুমোদন বাতিল করে। তবে প্লেসমেন্টের শেয়ারে লকইন ১ বছরের পরবর্তীতে ৩ বছর বাড়ানো হয়।

শেয়ারবাজারে ২০১০ সালে ধসে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) কোটা ব্যবস্থা অন্যতম। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য ৯০০ কোটি টাকার সহায়তা তহবিল গঠনে কাজ করে এই কমিশন। এই ৯০০ কোটি টাকা সুদসহ আদায়ের পর ফের নতুন পুনঃবরাদ্দের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।

বর্তমানে সরকার শেয়ারবাজারে কারসাজিরোধে বর্তমান কমিশন আধুনিক সার্ভিলেন্স সফটওয়্যার স্থাপন করেছে। এছাড়া শেয়ারবাজারের উন্নয়নে পাবলিক ইস্যু রুলসের আধুনিকায়ন করা হয়েছে, উদ্যোক্তা/পরিচালকদের অসৎ উদ্দেশ্য প্রতিরোধে বোনাস শেয়ার বিক্রিতে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ,

বিনিয়োগকারীদের সচেতন করতে বিনিয়োগ শিক্ষা, নিরীক্ষার মান উন্নয়নে প্যানেল অডিটরস গঠন এবং কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনয়নে যুগোপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক সুশাষন দিক নির্দেশনা (সিজিজি) জারি ও উদ্যোক্তা/পরিচালকদেরও ন্যুনতম শেয়ার ধারনের নির্দেশনা জারি করেছেন।

এদিকে শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা আনতে স্টক এক্সচেঞ্জে মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথকীকরণ (ডিমিউচুয়ালাইজেশন), ভুতুড়ে অমনিবাস হিসাবকে পৃথক করা, ১৯৬৯ অধ্যাদেশের যুগোপযোগী সংশোধনী ও সব শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা করা হয়েছে।

বর্তমানে বিএসইসি ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব সিকিউরিটিজ কমিশনসে (আইওএসসিও) বিএসইসি ‘এ’ ক্যাটাগরি অর্জন করেছে। যা ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর অর্জন হয়। এছাড়া বিএসইসির সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নিজস্ব ভবন তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয় বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, গত ৮ বছরে শেয়ারবাজারের জন্য যেসব সংস্কার হয়েছে, তাতে কিছুটা তো উপকার হয়েছেই। যে কারণে ২০১০ সালের পরে শেয়ারবাজারে কোন অবনতি হয়নি। আর আইওএসসিওতে বিএসইসির ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নিত হওয়া একটি স্বীকৃতি। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।

বিএসইসি চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন বলেন, আমাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেয়া। এ লক্ষ্যে আমরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে ৭০টি সংস্কার করা হয়েছে। এর ফলে পুঁজিবাজারের ভিত্তি মজবুত হয়েছে। যাতে পুঁজিবাজারে আরেকটি ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো ধস সৃষ্টির সুযোগ নাই।

তবে আইপিও অনুমোদনের জন্য সমালোচনায়ও পড়তে হয়েছে বর্তমান কমিশনকে। দুর্বল আইপিও নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনায় পড়তে হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএসইসি চেয়ারম্যানের বক্তব্য, তারা ডিসক্লোজার বেসিস আইপিও দিয়ে থাকে। ইস্যু ম্যানেজার যেসব কাগজপত্র জমা দেয়, তা যাচাই-বাছাই করেই আইপিও দিতে হয়। সত্যতা যাচাইয়ে কোম্পানি পরিদর্শনের সুযোগ আমাদের নেই। এক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজারদের সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পরিচালক ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, বর্তমান কমিশনের অনেক অর্জন রয়েছে। তিনি ২০১০ পরবর্তী বিনিয়োগকারীদের হতাশা দূর করতে সক্ষম হয়েছেন। যিনি শেয়ারবাজারের জন্য এমন একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন, যেখান থেকে খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই। এখন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে লাভবান হওয়া যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে কম সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জে ডিমিউচুয়ালাইজেশন হয়েছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহম্মেদ দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, অতীতে বিচ্ছিন্ন ভাবে রেগুলেটরি সংস্কারের মাধ্যমে সুফল পাওয়া যায়নি। তাই দীর্ঘমেয়াদে অর্থায়নের জন্য রেগুলেটরি ও প্রাতিষ্ঠানিক উভয় ধরনের সংস্কার করা আব্যশক। দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য কর প্রনোদণার পাশাপাশি সমন্বিত ভাবে আর্থিক ও মুদ্রানীতির পরিবর্তন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।