ফাতিমা জাহান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: স্থিতিশীল পুঁজিবাজার চান ২০১০ সালে ভয়াবহ কারসাজির ঘটনায় সর্বস্ব হারানো বিনিয়োগকারীরা। কারসাজির নয় বছর কেটে গেলেও কেউ ফিরে পাননি তাদের পুঁজি। এবার আ’লীগ সরকারের আমলে পুঁজিবাজার চাঙ্গা থাকবে এমন প্রত্যাশা ছিল ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের।

কিন্তু সা¤প্রতিক টানা দরপতনে কিছুটা সে আশায় গুড়োবালি ধারায় বিনিয়োগকারীদের। গত ২৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া দরপতন এখন ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে আরেক দফা ধসের রূপ নিয়েছে। নতুন এ ধসে বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ফলে ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীর এখন একটাই প্রত্যাশা, ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার।

ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্যমতে, চলতি বছরের ২৮ জানুয়ারি থেকে নতুন ধসের শুরু হয়েছে। সেদিন থেকে ২০ এপিল পর্যন্ত মোট ৫৬ কার্যদিবস উভয় বাজারে লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ৩৭ কার্যদিবস উত্থান আর ১৯ দিন পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। তাতে বিনিয়োগকারীরা পুঁজি হারিয়েছেন ৪৯ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। বিনিয়োগকারীরা এখন পুঁজি হারানোর ভয়ে চরম আতঙ্কে আছেন।

আর তাতে ব্রোকারেজ হাউজগুলোরও লোকসানের পাল্লাও ভারী হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, বাজারে এই রক্তক্ষরণের জন্য দায়ী নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ২০১০ সালের পর টানা নয় বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। এ সময় পুঁজিবাজার স্থিতিশীল না করে নিজের চেয়ারম্যান পদটি স্থিতিশীল রাখতে ব্যস্ত ছিলেন।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সব ধরণের দুর্নীতিকে প্রশ্নয় দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য সঠিত কমিশন বিনিয়োগকারীদের পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য কাজ করেছে। আর তার খেসারত দিচ্ছে বাজার।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, স¤প্রতি শেয়ারবাজারে গতি ফেরাতে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ২০১০ সালে ধসের পর ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় গঠিত বিশেষ তহবিল পুনঃবিনিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়তে সংশোধন করা হয়েছে এক্সপোজার। পাশাপাশি নতুন আইপিও আবেদন নেয়া বন্ধ করা হয়েছে।

প্লেসমেন্ট শেয়ারে তিন বছর লকিং (বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা) রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং এককভাবে ২ শতাংশ শেয়ার ধারনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তারা বলছেন, তিন মাসের বেশি সময় ধরে শেয়ারবাজারে মন্দাভাব বিরাজ করছে। স¤প্রতি টানা দরপতনে শেয়ারবাজারের সূচক যেভাবে পড়েছে, তাতে যে কোনো সময় ঘুরে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক বিষয়।

ঈদ পরবর্তী পুঁজিবাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে বিনিয়োগকারী মো. সোহাগ বলেন, স¤প্রতি বাজারের জন্য বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ফলে ঈদ পরবর্তী বাজারে চাঙাভাবের দেখা মিলেছে। আমাদের প্রত্যাশা বাজার খুব দ্রুত স্বাভাবিক আচরন করবে।

তিনি বলেন, তিন মাসের বেশি সময় ধরে বাজারে মন্দাভাব বিরাজ করছে। রোজার মাসের প্রায় পুরোটাই বাজার মন্দার মধ্য দিয়ে গেছে। ঈদের খরচ জোগাড় করতে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করেছি। পোর্টফোলিওতে যেসব শেয়ার আছে তাতেও লোকসানে আছি। ঈদের পর এখন বাজার ভালো না হলে পথে বসতে হবে।

মনির হোসেন নামে আরেক বিনিয়োগকারী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) স¤প্রতি পুঁজিবাজারের জন্য বেশকিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে সরকার পুঁজিবাজারের প্রতি মনোযোগী। শোনা যাচ্ছে বাজেটেও বেশকিছু প্রণোদনা দেয়া হবে। এতে আমরাও আশায় বুক বাঁধছি বাজার ভালো হবে।

তিনি বলেন, স¤প্রতি শেয়ারবাজার উন্নয়নে বিএসইসি বেশ তৎপর হয়েছে। ২০১০ সালের মহাধসের সময়ও বিএসইসিকে এতটা তৎপর দেখা যায়নি। এখন দেখার বিষয় বিএসইসি যেসব পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, সেগুলো কতোটা বাস্তাবায়ন হয়।

তিনি আরও বলেন, সা¤প্রতিক সময়ে যে নিরব দরপতন হয়েছে তাতে অনেক বিনিয়োগকারী পথে বসার উপক্রম। আমার পোর্টফোলিও দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। যে কয়টি কোম্পানির শেয়ার আমার কাছে আছে তারা সবগুলোরই দাম কমেছে। এভাবে দরপতন চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীদের বাজারের ওপর কোনো আস্থা থাকবে না।

পুঁজিবাজারের সা¤প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, স¤প্রতি পুঁজিবাজারের জন্য বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আমি আশা করছি। তবে স¤প্রতি যে দরপতন হয়েছে, তার কোনো যুক্তিসংগত কারণ আমি দেখি না।

ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়শনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সহায়তায় গঠিত বিশেষ তহবিল পুনঃবিনিয়োগ এবং ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আইপিও, প্লেসমেন্ট, বোনাস শেয়ারের ক্ষেত্রে সংশোধনী আনার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পরিচালকদের শেয়ার ধারনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেয়া হয়েছে। বাজেটেও বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হলে বাজেটের পর পুঁজিবাজার ভালো হবে বলে আমরা প্রতাশা করছি।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, পুঁজিবাজার কখন ভালো হবে, আবার কখন খরাপ হবে তা বলা সম্ভব না। তবে বাজারের জন্য স¤প্রতি বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হলে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।