দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: চীনে প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা। চীনের সীমানা ছাড়িয়ে এর মধ্যেই এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ১৯টি দেশ।  এখন পর্যন্ত চীনে করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২২ জনে, আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৫ হাজার। ভাইরাসের প্রবেশ ঠেকাতে চীনে উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করছে বিশ্বের অনেক এয়ারলাইন্স। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ৩০টির মতো এয়ারলাইন্স চীনে উড়োজাহাজ বাতিল করেছে। অনেক এয়ারলাইন্স কমিয়ে দিয়েছে উড়োজাহাজ। তবে এ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি বাংলাদেশ।

এদিকে করোনা ভাইরাসের শতভাগ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। রোগটির সংক্রমণের সব পরিবেশই এখানে বিদ্যমান। বিশেষ করে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড় হওয়ায় যেকোনো সময় রোগটির সংক্রমণ হতে পারে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, বাস-ট্রেন-লঞ্চে একসঙ্গে গাদাগাদি করে মানুষের যাতায়াত, হাঁচি-কাশির ব্যাপারে অসচেতনতা ও হাত ধোয়ার প্রবণতা কম হওয়ায় সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ঢাকা ও চট্টগ্রাম।

অন্যদিকে সমুদ্র পথে দেশের আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পন্ন হয়ে থাকে এ বন্দরে। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি হয়ে থাকে চীন থেকে।

বন্দরের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিমাসে চীন থেকে ১৪-১৫টি কনটেইনার জাহাজ এবং ৪ থেকে ৫টি জেনারেল কার্গো জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। এ কারণে প্রতিদিন চীনের বিভিন্ন বন্দর থেকে দেশি-বিদেশি পণ্য বোঝাই জাহাজ নিয়ে নাবিকরা আসেন চট্টগ্রাম বন্দরে। ফলে ‘করোনা ভাইরাস’ ঝুঁকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এই ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কোনো নির্দিষ্ট প্রাণী থেকে ভাইরাসটি মানুষের দেহে প্রথমে ঢুকেছে। এরপর মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়েছে এবং এটা এখনো ছড়িয়ে চলেছে। চীনের অন্যতম সমৃদ্ধ শহর উহান শহরে সামুদ্রিক মাছ বিক্রি করে এমন একটি বাজার থেকে এটা প্রথম ছড়িয়েছে। ওই বাজারে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী কেনাবেচা হতো। ‘২০১৯ নোবেল করোনা ভাইরাস’ চীনের উহান শহর থেকে প্রথমে চীনেরই অন্যান্য শহরে ছড়িয়েছে এবং সেখান থেকে থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে ছড়িয়েছে। কারণ এসব দেশের সাথে চীনের যোগাযোগ খুবই ভালো।

এদিকে চীনের করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে চীনে চার শতাধিক লোকের মৃত্যুর কারণে এই আতঙ্ক দিন দিন বাড়ছে। তাই সমুদ্রগামী জাহাজের মাধ্যমে মরণঘাতী এই ভাইরাস যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, সে লক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক।

অন্যদিকে আক্রান্তের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় এখনো দুর্বলতা রয়েছে দেশে। রোগী বেড়ে গেলে হাসপাতালে আইসোলেশন করে কীভাবে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হবে, সেটা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে হাসপাতালগুলোয় যথোপযুক্ত পরিবেশ নেই। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও এ ব্যাপারে অসচেতনতা রয়েছে।

বিশেষ করে করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত করা ও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে যেসব সতর্কতা ও ব্যবস্থাপনা দরকার, সেটা এখানে কতটুকু সম্ভব সে নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন রোগতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাদের মতে, হাসপাতাল থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি।

এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) পরামর্শক ও সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, বিশ্বব্যাপী ঝুঁকির কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলে দিয়েছে।

সে ঝুঁকি আমাদের জন্যও। মূলত দুই কারণে এখানে ঝুঁকি বেশি এক. রোগী শনাক্ত করতে আর্লি ডায়াগনসিস ও দুই. আক্রান্তদের চিকিৎসায় হাসপাতাল তৈরি করা। এই দুই ক্ষেত্রেই আমাদের দুর্বলতা রয়েছে। এ দুটি ঠিকমতো করতে পারলে, করোনাভাইরাস মোকাবিলা সম্ভব।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে শতভাগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে মনে করেন আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বর্তমানে চীন থেকে ফেরত আনা ৩১২ বাংলাদেশিকে রাখা আশকোনা হজক্যাম্পের দায়িত্বে রয়েছেন। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, যেকোনো সময় যেকোনো দেশ সংক্রমণ হতে পারে। এ ঝুঁকি আমাদের জন্য শতভাগ। সংক্রমণের সব উপাদানই এখানে রয়েছে। কারণ চীনের সঙ্গে যোগাযোগ নিবিড়। এখনো চীন থেকে লোকজন আসছে।

ঝুঁকির মূল কারণ দুটি উল্লেখ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, রোগটি শনাক্ত করা ও আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট এবং হাসপাতালকে সংক্রমণমুক্ত রাখাই আমাদের মূল ঝুঁকি। আমাদের হাসপাতালগুলোর ইনফেকশন ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়। তাই এখান থেকেই ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এদিকে চীনে ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস যেন কিছুতেই দেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক ব্যবস্থা নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাইরাসটি যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশে আসতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে রোগটির সংক্রমণ ঠেকাতে বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ থেকে চীনে ও চীন থেকে বাংলাদেশে সব ধরনের ভ্রমণ স্থগিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই চীন থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশিকে দেশে এনে আশকোনা হজক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে।

কারও ব্যাপারে কোনো সন্দেহ দেখা দিলে তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আইসোলেশন করে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আক্রান্ত রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে আগাম প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশের সরকারি হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট খোলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। গতকালও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৃথক ইউনিট খোলা হয়েছে।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ দেশের তিন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীনসহ ইতিমধ্যেই যেসব দেশে রোগটি দেখা দিয়েছে, সেখান থেকে আসা সবাইকে স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। দেশের সব স্থল ও নৌবন্দরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা যাত্রীদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রতিদিন রোগটির সর্বশেষ তথ্য দিতে আইইডিসিআর সংবাদ সম্মেলন করছে।

ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। কারণ আমাদের লোকজন চীন থেকে এখনো আসছে। এখন দরকার যারা আসছে তাদের আর্লি ডায়াগনসিস করা। টেস্ট করে সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেট করতে হবে যাতে তার থেকে না ছড়ায়। অন্যান্য দেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকদের আলাদা করে রাখা হচ্ছে।

এ বিশেষজ্ঞ বলেন, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে। আইসিইউ লাগবে। আইসোলেট করার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয় সুস্থ ব্যক্তিদের। যারা আক্রান্ত তাদের আইসোলেট করে রাখতে হয়। আমাদের এখানে আইসোলেশন ব্যবস্থা কম। আশকোনায় সবাইকে আলাদা করে রাখা উচিত। আর যদি আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যায়, তাহলে কুর্মিটোলায় আইসোলেট রেখে চিকিৎসা দিতে হবে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক রুমে রাখা যেতে পারে। কারণ তাদের সবাই আক্রান্ত। আর যারা আক্রান্ত হয়নি, তারা সুপ্ত অবস্থাতেই অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে। সেজন্য তাদের আলাদা করে রাখতে হবে।

‘তবে করোনাভাইরাস নিয়ে এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়ে কম ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে না এলে রোগটি ছড়াবে না। তাছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি বা থুতু হাতে লাগলে সে থেকে ছড়াতে পারে। এটা ছোঁয়াচে রোগ।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, চীন থেকে কেউ অগোচরে এসে যাতে রোগটি ছড়াতে না পারে, সেজন্য সার্ভিলেন্স ব্যবস্থা জোরালো করা হয়েছে। তবে আমাদের ভয়টা যদি একসঙ্গে বেশি আক্রান্ত হয়, তাহলে। কারণ আমাদের হাসপাতালে ল্যাবরেটরি সার্ভিস ও সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী নয়। হাসপাতালকে নিয়েই বেশি ভয়। সেখান থেকেই ছড়ানোর আশঙ্কা বেশি। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, মুরগিসহ প্রাণীর বাজার থেকেও ছড়াতে পারে। সেখানকার পরিবেশ খুবই উদ্বেগজনক। আমাদের শঙ্কার জায়গা হলো আমাদের ব্যবস্থাপনা।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা ‘বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এখন পৃথিবী অনেক কাছে চলে এসেছে। চীন থেকে এখনো লোকজন আসছে। তাই ঝুঁকিও রয়েছে। আর সেজন্যই এত প্রস্তুতি।