দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: নানামুখী গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজার অস্থিতিরতার নেপেথ্যে কারা এ প্রশ্ন এখন ২৮ লাখ বিনিয়োগকারীদের মুখে মুখে। সরকারের নানা আন্তরিকতার ফলে বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। বরং বাজার আজ ভাল তো কাল খারাপ। এ অবস্থার মধ্যে দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ২০১৯ সালের শুরুতে অনেকটাই আশাবাদী ছিলেন পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু বছর শেষে হতাশ বিরাজ করছে। সেই হতাশার বিরাজ আজও চলছে।

২০২০ সালের শুরুতে বিনিয়োগকারীরা বাজার নিয়ে আশাবাদী থাকলেও টানা দরপতন অব্যাহত রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন এ দরপতনের শেষ কোথায়। বর্তমান বাজার পরিস্থিতি ২০১০ সালের চেয়েও ভয়াবহ। পুঁজিবাজারে গুজব রটিয়ে একটি চক্র ফায়দা লুটছে। এরা কারা। এদের খুঁজে বের করা উচিত। এরা মুজিব বর্ষে পুঁজিবাজারকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে। এ চক্রটি পুঁজিবাজারে খুব শক্তিশালী। এদের কারনে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না।

এদিকে পুঁজিবাজার স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক তফসিলি ব্যাংকগুলোকে ২০০ কোটি টাকা করে বিনিয়োগের জন্য বিশেষ তহবিল গঠনের সুযোগ দিয়েছে। যা নিজস্ব অর্থায়ন বা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সহজ ঋণের মাধ্যমে করা যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১০ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করলেও ব্যাংকগুলোর এখনো তেমন সাড়া নেই। এক মাস অতিবাহিত হলেও ব্যাংকগুলোর নিরব ভুমিকার ফলে ক্ষোভ বিরাজ করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

বিনিয়োগকারীদের প্রশ্ন বাজার কেন স্থিতিশীল হচ্ছে না। তবে সরকারের নানামুখী আন্তরিকতার ফলে পুঁজিবাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। পুঁজিবাজারে একটি সিন্ডিকেট চক্র বাজারকে অস্থিতিশীল করতে নানা গুজব ছড়াচ্ছে। এ অস্থিতিশীলতার নেপেথ্যে শীর্ষ সিকিউরিটিজের কয়েকজন উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ জড়িত।

বাজার বিশ্লেষনে দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাজারে কেমন যেন এক ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। কিছুতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না দেশের পুঁজিবাজার। গতি ফেরাতে নানা ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ার পরও পুঁজিবাজার এক কঠিন সময় পার করছে। গত কয়েক মাসের পতনে সূচক নেমে গেছে ৪ হাজার পয়েন্টের নিচে। আর লেনদেনেও দেখা দিয়েছে দৈন্যদশা। বাজারের এমন আচরণে শঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা। কেননা গত কয়েক মাসের পতনে প্রায় ৮০ শতাংশ পুঁজি হারিয়ে হাহাকার করছেন তারা। এমনকি লভ্যাংশ ও ইপিএসের মৌসুমের পরও সূচকের অবস্থান কয়েক বছরের সর্বনিম্নে চলে এসেছে। এমনকি বেশীরভাগ কোম্পানির শেয়ার দর এযাবৎ কালের সর্বনিম্নে অবস্থান করছে।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, সূচকে এমন বড় পতন ঘটানোর পেছনে কারসাজি চক্র বা গ্যাম্বলারদরে হাত রয়েছে! সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর দুর্দান্ত কৌশল হিসেবে তারা এখন বাজার ফেলে দিচ্ছে। মূলত মার্কটে ফলে দিয়ে কম দাম শেয়ার কিনে নেয়াই তাদের আসল উদ্দেশ্য। এজন্যই করোনাভাইরাসে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ও নানা ইস্যু কাজে লাগিয়ে গুজব ছড়িয়ে পুঁজিবাজারকে অস্থিরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এ কৌশলের কাছে প্রতিনিয়ত মার খাচ্ছি আমরা।

তবে এটা দেখার মত কেউ পুঁজিবাজারে আছে বলে মনে হয় না! মূলত নিয়ন্ত্রকরা এ সমস্ত কারণেই সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে মানুষ ব্যাংকে কম সুদে অর্থ ফেলে রাখলেও পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সাহস পান না। কারণ ব্যাংকে অর্থ রাখলে পুঁজির নিশ্চয়তা আছে। কিন্তু পুঁজিবাজারে সে নিশ্চয়তা নেই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ও নিয়ন্ত্রকদের নানাবিধ সংস্কারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছিল তা পূরণ না হওয়ায় হতাশা তৈরি হয়েছে। নতুন নতুন খবরেও কাজ না হওয়ায় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রতিনিয়ত কমছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবিও মাঝে মাঝে মন্দা বাজারে শেয়ার বিক্রি করে। মূলত প্রাতিষ্ঠানিকদের শুভ দৃষ্টি না থাকার সঙ্গে যোগ হয়েছে কারখান বন্ধসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের রেড জোনো থাকার খবর, যা টানা দরপতনকে উসকে দিয়েছে।

এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে সক্রিয় নেই। আইপিও আইন সংশোধনসহ নানা ইস্যুতে তারা বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন। বিনিয়োগে নেই বিদেশিরাও। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সার্বিক বাজারে। যা বিনিয়োগকারীদের হতাশার বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন তারা।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বড় ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এ কারণে দেশি-বিদেশি সব ধরনের বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়িয়েছেন। এর ফলে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে।’ ‘কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দেশে কি পরিমান ক্ষতি হবে বা অর্থনীতিতে কেমন প্রভাব পড়বে তা তারা জানে না। না জেনেই একটি কুচক্রি মহলের প্রচারণায় কান দিয়ে শেয়ার বিক্রির হিড়িক ফেলেছে। এতে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

জানা যায়, একটি কুচক্রিমহল গুজব ছড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস মহামারি আকার ধারণ করেছে এবং দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। তাই বাংলাদেশে বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা শেয়ার বিক্রি করে চলে যাবে। তখন বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে পতন হবে। আর এই গুজবে কান নিয়ে কিছু বিনিয়োগকারী শেয়ার বিক্রির জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এবং বাজারে পতন হচ্ছে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমরা ডিএসইর কাছে দুই সপ্তাহ লেনদেন বন্ধ রাখার দাবি জানিয়েছিলাম। তবে ডিএসইর এমডি আমাদের বলেছেন- আগামীকাল থেকে শেয়ারবাজার ভালো হয়ে যাবে। তার কথার ওপর ভিত্তি করে আমরা দুইদিন বাজার পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই দুই দিনের মধ্যে বাজার ভালো না হলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।

আর সংগঠনটির সভাপতি মিজানুর রশিদ চৌধুরী বলেন, কারসাজিচক্র পরিকল্পিতভাবে শেয়ারবাজারে দরপতন ঘটাচ্ছে। এই দরপতন ঘটাতে তারা করোনাভাইরাসকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। করোনাভাইরাস আতঙ্কে আমাদের শেয়ারবাজারে দরতপন হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই আমাদের দাবি এই কারসাজিচক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। সেইসঙ্গে কিছুদিনের জন্য শেয়ারবাজারে লেনদেন বন্ধ রাখতে হবে। সেইসঙ্গে নিয়ম করতে হবে প্রতিদিন প্রতিটি ব্রোকারেজ হাউজকে কমপক্ষে দুই কোটি টাকার লেনদেন করতে হবে।

এএফসি ক্যাপিটাল লিমিটেড প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব এইচ মজুমদার বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে দেশের শেয়ারবাজারে যে অবস্থা চলছে তা খুবই ন্যাক্কারজনক। আমাদের বাজার সম্পর্কে ভালো ধারনা নেই অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর। তাই বিভিন্ন মহলের কথা শুনে শেয়ার কিনছে এবং বিক্রি করছে। এতে বাজারের যে স্বাভাবিক গতি থাকার কথা তা থাকছে না। বাজার খুব অস্বাভাবিক গতিতে উঠা-নামা করছে।’‘

তবে বিনিয়োগকারীদের উচিত গুজবে কান না দিয়ে প্রকৃত অবস্থা জেনে শেয়ার কেনা ও বিক্রি করা।  তিনি আরো বলেন, একটি চক্র বাজার নিয়ে গুজব রটাচ্ছে। এই চক্রটি বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, বিনিয়োগকারীদের আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। তাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আতঙ্কে পেনিক সেল না দিয়ে, শেয়ার ধরে রাখতে হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সবাই বাজার ভালো করতে চেষ্টা করছে। সুতরাং আমি বিশ্বাস করি এই বাজার ভালো হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো না। আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ছে। শেয়ারবাজারে এর প্রভাব পড়ছে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।