দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: মার্কিন কূটনৈতিক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেলে বাংলাদেশ। দেশের সার্বিক অর্থনীতি ত্বরান্বিত করতে ৪৫ বছর ধরে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে পুঁজিবাজার। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর মাত্র ১৩ কোটি টাকায় শুরু হওয়া এ বাজারের আকার বর্তমানে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। দিন যত যাচ্ছে দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান তত বাড়ছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানও এখন তালিকাভুক্ত হচ্ছে এখানে। দেশের সাধারণ মানুষও উন্নয়নের মালিকানায় অংশীদার হচ্ছেন।

স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে মাত্র ১৩ কোটি টাকা দিয়ে শুরু হওয়া বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এখন সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাজারের অবদান দিন দিন বাড়ছে। দেশে এবং দেশের বাইরের সাধারণ মানুষও শেয়ারবাজার উন্নয়ন ধারায় অংশীদার হচ্ছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় তালিকাভুক্ত মাত্র নয়টি প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন ছিল ১৩ কোটি টাকা।

কোম্পানিগুলো হলো: আলফা টোব্যাকো ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড, বার্মা ইস্টার্ণ লিমিটেড, বাংলাদেশ অক্সিজেন লিমিটেড, বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানি লিমিটেড, ইস্টার্ন লুব্রিক্যান্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, গ্ল্যাক্সো বাংলাদেশ লিমিটেড, জিএমজি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশন লিমিটেড, দি ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড এবং আইসিবি বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারার কোম্পানি লিমিটেড।

গত ৪৫ বছরে শেয়ারবাজারে ৩৭৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনাইটেড পাওয়ার, রেনেটা ফার্মা, ওয়ালটন হাইটেক ইন্ডাস্ট্রিজ, বেক্সিমকো ফার্মা ও বেক্সিমকো লিমিটেডের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের দেখাদেখি গ্রামীণফোন, রবি আজিয়াটা ও ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকোর মতো বিদেশি প্রতিষ্ঠানও তালিকাভুক্ত হয়েছে।

এছাড়া ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ২২২টি ট্রেজারি বন্ড ও দুটি করপোরেট বন্ড এবং আটটি ডিভেঞ্চারসহ মোট ৬১৫টি প্রতিষ্ঠান এই বাজারের তালিকাভুক্ত। ফলে ডিএসই’র বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকায়। এতে একদিকে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে মানুষের অংশগ্রহণ যেমন বাড়ছে, তেমনি লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের সুনাম বাড়ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না। স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর নয়টি প্রতিষ্ঠানের তালিকাভুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৬ সালের ১৬ আগস্ট যাত্রা শুরু হয় শেয়ারবাজারের। তবে সর্বপ্রথম ১৯৫৪ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান স্টক এক্সচেঞ্জ নামে যাত্রা শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির। এরপর নাম পরিবর্তন করে ১৯৬৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) নামে পথচলা শুরু করে এটি। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাজারটির আকার ছিল খুবই ছোট।

১৯৯০ এর পর দেশে শিল্প-কলকারখানা সম্প্রসারিত হতে থাকে। উদ্যোক্তাদের প্রয়োজন হয় অর্থের। তারা ব্যাংক ঋণের বিপরীতে বিনা সুদে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ব্যবসা সম্প্রসারণ ও পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর বাজারটি সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করতে ১৯৯৩ সালে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন করা হয়।

যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নামে পরিচিতি পায়। শেয়ার হোল্ডারদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য গঠিত কমিশনের দুই বছর পর ১৯৯৫ সালে প্রতিযোগিতামূলক শেয়ারবাজার গঠনের লক্ষ্যে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আরও একটি শেয়ারবাজার গঠন করা হয়। যার নাম রাখা হয় চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই)। এরপর মানুষ বাজারমুখী হতে শুরু করে।

কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজারের ধস। কারসাজি চক্রের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে শুরু হয় তদন্ত। বেশকিছু সংস্কারও আনা হয়। ১৯৯৮ সালের ১০ আগস্ট চালু হয় অটোমেটিক ট্রেডিং। কাগজের শেয়ার থেকে ডিমেট শেয়ারে রূপান্তর করতে ২০০৪ সালে ২৪ জানুয়ারি সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল) গঠন করা হয়। ওই বছরই যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।

বিশ্বের অন্যান্য শেয়ারবাজারের মতো বৈচিত্র্য আনতে ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি সরকারি বন্ড মার্কেট চালু করা হয়। ২০০৬ সালের ১২ এপ্রিল সরাসরি তালিকাভুক্তির নিয়মও চালু হয় শেয়ারবাজারে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। ওই সময় অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়। আবারও চাঙা হতে শুরু করে বাজার।

এটি এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে ২০১০ সালে নতুন করে আইপিও বুক বিল্ডিং পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর আরেক দফা ধস নামে শেয়ারবাজারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশকিছু সংস্কারের কথাও বলা হয়। কারসাজি চক্রের বিচার করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত ওই ট্রাইব্যুনালে ২৫টির মতো মামলার বিচার হয়েছে।

অন্যদিকে, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে ২০১৩ সালের ২৮ জানুয়ারি ডিএসইতে ডিএসইএক্স ও ডিএস-৩০ সূচক যোগ করা হয়। শেয়ারবাজার আরও জনপ্রিয় করতে ২০১৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা ওয়েবসাইট চালু হয়। একই বছরের ২১ নভেম্বর শুরু হয় ডিমিউচ্যুয়ালাইজেশন। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি ডিএসইতে শরীয়াহ সূচকের যাত্রা শুরু হয়। লেনদেন আরও সহজ করতে ২০১৫ সালে ডিএসই মোবাইল অ্যাপ চালু করে। এর মাধ্যমে ঘরে বসেই লেনদেন করার সুযোগ পার বিনিয়োগকারীরা।

স্বাধীনতার এত বছর পরও শেয়ারবাজার তার সঠিক আচরণ করতে পারছে না। দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি শেয়ারবাজারের অবদান দরকার ছিল। কিন্তু ব্যাংক ঋণ নেওয়া সহজ হওয়ায় এ বাজারমুখী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। বিশ্বশেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ২০১৫ সালে আইএসও সদস্যভুক্ত করে। এরপর টানা তিন বছর টালমাটাল থাকে শেয়ারবাজার। ২০২০ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বের সেরা উত্থানের তালিকায় উঠে আসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারকে ব্র্যান্ডিং করতে রোড শোর আয়োজন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। বর্তমানে দেশের দুটি শেয়ারবাজারে ২০ লাখ ৩২ হাজার ৩২৬ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স ব্যবসা করছেন। এর সঙ্গে পাঁচ শতাধিক ব্রোকার হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।

এছাড়াও যুক্ত আছেন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ বাজারের সঙ্গে দুই থেকে তিন কোটি মানুষের ভাগ্য জড়িত। দেশ স্বাধীনের পর মাত্র ৯টি কোম্পানির ১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা করা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের এখন তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৮২টি।

স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৭৫ কোটি টাকায়। জিডিপিতে যার অবদান ১৭.৭০ শতাংশ। বিশ্ববিখ্যাত চীনের শেনজেন ও সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের অংশীদার হিসেবে কাজ করছে। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিডিবিএল)-এর তথ্য মতে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ২০ লাখ ১৭ হাজারের বেশি বিও হিসাবধারী বিনিয়োগকারী রয়েছেন।

বর্তমানে দেশের দুটি পুঁজিবাজারে ২০ লাখ ৩২ হাজার ৩২৬ বেনিফিশিয়ারি ওনার্স ব্যবসা করছেন। এর সঙ্গে পাঁচ শতাধিক ব্রোকার হাউজের কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত। এছাড়াও যুক্ত আছেন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ বাজারের সঙ্গে দুই থেকে তিন কোটি মানুষের ভাগ্য জড়িত।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূলধন দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যা ছিল মাত্র ১৩ কোটি টাকা।

ডিএসই পরিচালক হন শাকিল রিজভী বলেন, দেশের পুঁজিবাজার এগিয়ে চলছে। অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। স্বাধীন না হলে তো স্বাধীনভাবে স্টক এক্সচেঞ্জ চলতে পারত না, উদ্যোক্তারাও অর্থ সংগ্রহের উৎস খুঁজে পেতেন না।

বিজয়ের ৫০ বছরে এসে পুঁজিবাজারের অর্জন কী? জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার ড. শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পুঁজিবাজার এখন একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। এটি যে দেশের সার্বিক অর্থনীতির মূল উৎস, তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। উদ্যোক্তারা এখানে এসে সহজে যাতে অর্থ উত্তোলন করতে পারেন সেই লক্ষ্যে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে।

সাবেক তত্তাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও পুঁজিবাজার তার সঠিক আচরণ করতে পারছে না। দেশের অর্থনীতিতে আরও বেশি পুঁজিবাজারের অবদান দরকার ছিল। কিন্তু ব্যাংক ঋণ নেয়া সহজ হওয়ায় এ বাজারমুখী হচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। ফলে এখনও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি দেশের পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ব্যাংক থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে বলে মত দেন এ অর্থনীতিবিদ।