দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বীমা খাতের কোম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডে জালিয়াতির মাধ্যমে যে লুটপাট চালানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন কোম্পানিটির চার সাবেক পরিচালক। সম্প্রতি এক চিঠিতে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) চেয়ারম্যানের কাছে এক চিঠিতে লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা। সাবেক পরিচালকরা হচ্ছেন- মোহাম্মদ হেলাল মিয়া, নাজনীন হোসেন, মো. কামরুল হাসান ও শেহের বানু।

অবশ্য আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ রয়েছে যে, তিনি ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অর্থ আত্মসাতে জড়িতদের একজন সুবিধাভোগী। আইডিআরএ চেয়ারম্যান নিজে ফারইস্ট লাইফে দীর্ঘদিন উচ্চপদে চাকরি করেছেন। প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালক হিসেবেও ছিলেন। এছাড়া অর্থ আত্মসাতে জড়িত উদ্যোক্তা-পরিচালকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘসময় কাজ করেছেন মোশাররফ। এই চেয়ারম্যানের কাছেই চিঠি লিখে ফারইস্ট লাইফের অর্থ আত্মসাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সাবেক ওই পরিচালকরা।

নিকটাত্মীয়দের মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যে জমি ক্রয় ও ব্যাংকে রাখা আমানতের বিপরীতে কোম্পানির পরিচালক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে ফারইস্ট লাইফের ২ হাজার ১২৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেছেন কোম্পানিটির উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। দেশের বীমা শিল্পে নজিরবিহীন এই লুটপাটে সহায়তা করেছেন পরিচালনা পর্ষদ ও বিভিন্ন বোর্ড কমিটি এমডিসহ কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সম্প্রতি আইডিআরএ চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে সাবেক ওই চার পরিচালক জানিয়েছেন, ফারইস্ট লাইফের পরিচালনা পর্ষদের মোট ১৩টি সভার কার্যবিবরণীতে রক্ষিত আলোচ্যসূচি ও সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এক্সট্র্যাক্ট বা প্রতিলিপি তৈরি ও ইস্যু করে কোম্পানি বিভিন্ন ব্যাংকে রাখা শরিয়াহ্ভিত্তিক আমানত লিয়েন (জামানত) রেখে স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়া হয়।

সাবেক পরিচালকদের দাবি, পর্ষদ সভার মূল কার্যবিবরণীতে আলোচ্যসূচি ও সিদ্ধান্তে এসব বিষয় নেই। স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানির আমানতের বিপরীতে ঋণ কিংবা বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি পর্ষদ সভায় আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি।

ফরইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ১৫৮, ১৬১, ১৬৪, ১৬৮, ১৬৯, ১৭১, ১৭২, ১৭৯, ১৮৪, ১৯৫, ১৯৭, ১৯৮ ও ২০৩তম সভার আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে যে প্রতিলিপি তৈরি ও ইস্যু করা হয়েছে, তা মূল কার্যবিবরণীর মধ্যে পার্থক্য বা গরমিল রয়েছে, যা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন সাবেক পরিচালকদের একাংশ। পরিচালকরা জানিয়েছেন, কার্যবিবরণী জালিয়াতির মাধ্যমে স্বার্থসংশ্লিষ্ট নয় এমন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি যথাক্রমে পিএফআই প্রপার্টিজ লিমিটেড, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, ম্যাকসনস বাংলাদেশ লিমিটেড,

ম্যাকসনস অ্যাসোসিয়েটস, মোল্লা এন্টারপ্রাইজ, এ কে এম খালেদ, মিথিলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, এম এ খালেক, মিথিলা প্রপার্টিজ, আজাদ অটোমোবাইলস ও কামালউদ্দিনকে কোম্পানির শরিয়াহ্ভিত্তিক আমানত ও ভবিষ্যতে রক্ষিত তহবিল লিয়েন রেখে বিনিয়োগ বা ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের রাখা বিভিন্ন শরিয়াহভিত্তিক আমানত লিয়েন রেখে শত শত কোটি টাকা সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ও ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

বেশ কয়েকটি পর্ষদ সভায় বিভিন্ন ব্যাংকে শরিয়াহভিত্তিক আমানত রাখার সিদ্ধান্ত হলেও পর্ষদসভার আলোচ্যসূচি ও সিদ্ধান্তের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতিলিপি বানিয়ে তাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কোম্পানির আমানতের বিপরীতে ঋণসুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়টি যুক্ত করা হয়, যা যোগসাজশি, প্রতারণা ও কোম্পানির স্বার্থপরিপন্থী বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক ওই পরিচালকরা।

ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা নিয়ে তদন্ত ও বিশেষ নিরীক্ষা চালিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি)। ওই নিরীক্ষা ও তদন্তে দেখা যায় যে, নিকটাত্মীয় ও ব্যবসায়িক অংশীদারদের মাধ্যমে জমি কিনে ফারইস্ট লাইফের ৮৫৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন কোম্পানিটির অপসারিত চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।

এছাড়া প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি ও প্রাইম এশিয়া ফাউন্ডেশনের নামে ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে বেআইনি বিনিয়োগ করে ১২৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন নজরুল ইসলাম, এম এ খালেকসহ কয়েকজন পরিচালক। এর বাইরে কর্মচারীদের স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক হিসাব খুলে ভুয়া কমিশন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে নজরুলের বিরুদ্ধে। কোম্পানির কর্মচারীদের নামে দুটি সমবায় সমিতি বানিয়ে আরও ১৯১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা।

এসইসির তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকে ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার এমটিডিআর করে ফারইস্ট লাইফ। ওই এমটিডিআর লিয়েন রেখে উদ্যোক্তা-পরিচালক এম এ খালেক ব্যক্তিগতভাবে ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পিএফআই সিকিউরিটিজ, প্রাইম প্রপার্টি হোল্ডিংস, প্রাইম ইসলামী সিকিউরিটিজ, ম্যাকসনস অ্যাসোসিয়েটস ও ম্যাকসন্স বিডি লিমিটেডের মাধ্যমে ৩১২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ঋণ নেন এবং যথারীতি খেলাপি হয়ে পড়েন।

এর ফলে ঋণপ্রদানকারী ব্যাংকগুলো ওইসব এমটিডিআর লিক্যুইডেট করে। আর ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স তাদের হিসাবে ৪১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা এম এ খালেকের নামে ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে দেখায়। ২০১৮ সালের ৩ নভেম্বর ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকার দায় স্বীকার করে ফারইস্ট লাইফের সঙ্গে খালেক একটি সমঝোতায় পৌঁছান।

কোম্পানির করপোরেট বুকস অব অ্যাকাউন্টস তদন্তে দেখা যায় যে, কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালক ও শীর্ষ কর্মকর্তা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট ১৩ জনকে ব্যাংকঋণের সুবিধা দিতে বোর্ডসভার কার্যবিবরণী নকল করে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিট (এমটিডিআর) খুলে কোম্পানির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, পরিচালক এম এ খালেক, কে এম খালেদ, মিজানুর রহমান, তাসলিমা ইসলাম,

এম এ ওয়াহাব, ডা. ইফ্ফাত জাহান, আয়শা হোসনে জাহান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেমায়েত উল্লাহ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে মুদারাবা টার্ম ডিপোজিটের বিপরীতে ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। আর এসব ঋণ ও এর সুদ পরিশোধ না করায় ফারইস্টকে প্রায় ৬৫৯ কোটি টাকার এমটিডিআর সমন্বয় করতে হয়।