দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারের একটি গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিদায় নিচ্ছে ২০২১ সাল। দীর্ঘ এক দশক পর ২০২১ সালজুড়েই দেশের পুঁজিবাজারে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাজারের গতিশীলতা। বিদায়ী বছরে করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কঠোরতম লকডাউনের মধ্যেও ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশের পুঁজিবাজার চালু থাকে৷ নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেশের শেয়ারবাজার। করোনা অতিমারির মধ্যেও দীর্ঘ এক দশক পর প্রতিদিনই নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ে পুঁজিবাজার। সামগ্রিক অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও চমক দেখায় দেশের পুঁজিবাজার।

দেশের পুঁজিবাজারের উন্নয়ন, গুণগত পরিবর্তন ও স্থিতিশীল বাজার গঠনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো ২০২১ সাল। ২০১০ সালের বাজারের করুণ অবস্থা সবার জানা। এমন পরিস্থিতি দ্বিতীয়বার আশা করছেন না বিনিয়োগকারী ও বাজার সংশ্লিষ্টরা। এর মধ্যে করোনার কঠিন সময়ে ঝুঁকিপূর্ণ থাবায় পড়েও চমক ধরে রেখেছে পুঁজিবাজার। দীর্ঘ এক দশক পর ২০২১ সালজুড়েই দেশের পুঁজিবাজারে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাজারের গতিশীলতা।

করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কঠোরতম লকডাউনের মধ্যেও ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে চালু ছিলো শেয়ারবাজারে লেনদেন। এর ফলে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেশের শেয়ারবাজার। সামগ্রিক অর্থনীতিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও চমক দেখিয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। দেশের বড় শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইক্সও এ বছরই প্রথমবারের মতো ৭ হাজার পয়েন্ট অতিক্রম করে নতুন রেকর্ড গড়েছে।

বর্তমান কমিশনের উদ্যোগে বাজারে নতুন বিনিয়োগ আসায় গতিশীলতা ফিরেছে৷ সেসঙ্গে বেড়েছে নতুন বিনিয়োগকারীও৷ প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ের সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ায় প্রধান শেয়ারবাজারের লেনদেন বিগত ১০ বছরে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। একইভাবে লেনদেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সার্বিক সূচক। এতে বাজারের গভীরতা যেমন বৃদ্ধি পায়, তেমনি বৃদ্ধি পায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা।

নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও অভাবনীয় ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে শেয়ারবাজার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গের তথ্যের ভিত্তিতে এশিয়া ফ্রন্টিয়ার ক্যাপিটালের এক প্রতিবেদনে পারফরম্যান্স বিবেচনায় বিশ্বে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে দেশের শেয়ারবাজার। এর আগে গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরেও ‘বিশ্বসেরা’ হয় দেশের শেয়ারবাজার। বাজারের গতিশীলতা ধরে রাখতে দেশ এবং দেশের বাইরে ব্রোকারেজ হাউজের শাখা বা ডিজিটাল বুথ চালু করা হয়েছে এবছর৷

ওভার দি কাউন্টার মার্কেট বাতিল : এবছর পুঁজিবাজারে সবচেয়ে আলোচিত ওভার দি কাউন্টার মার্কেট বিলুপ্তি। এরপর ওটিসি মার্কেটের ১৮টি কোম্পানি, ১৪টি বন্ড এবং বেশ কিছু ওপেন এন্ড মিউচ্যুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ড (এটিবি) চালু করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে৷ একটি উন্নত ও কার্যকর বন্ড মার্কেট প্রতিষ্ঠার লক্ষে ইতোমধ্যেই বহুল প্রতীক্ষিত গভর্নমেন্ট ট্রেজারি বন্ডের পরীক্ষামূলক লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে৷

শিগগিরই প্রয়োজনীয় সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট সম্পাদনের মাধ্যমে সার্বজনীনভাবে গভর্মেন্ট ট্রেজারী বন্ডের লেনদেন স্টক এক্সচেঞ্জের ট্রেডিং প্ল্যাটফর্মে শুরু হবে৷ ব্রোকারেজ হাউজগুলোকে এপিআই সংযোগের মাধ্যমে নিজস্ব ওএমএস চালুর মাধ্যমে গ্রাহক সেবার উন্নতি করণের লক্ষ্যে দুটো ব্রোকারেজ হাউজকে ডিএসই ফিক্স সার্টিফিকেশন প্রদান করেছে৷ আশা করা যাচ্ছে নতুন বছরের শুরুতেই এসব অর্জনের মাধ্যমে পুঁজিবাজারের এক নতুন মাত্রা যোগ হবে।

পুঁজিবাজার উন্নয়নে রোড-শো : অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতির চিত্র ও পরিবেশ বিনিয়োগের অনুকূল৷ ফলে বাংলাদেশ আজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারী এবং বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় শেয়ারবাজার বিষয়ে রোড-শো’র শুরু করে৷ ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চারটি অঙ্গরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, লন্ডনে রোড-শো’ সম্পন্ন করেছে এবং আরো বেশ কয়েকটি দেশে রোড-শো’র আয়োজন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

৫৪টি নতুন ট্রেক হস্তান্তর : টেকসই উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এবছর ডিএসইর ৫৪টি নতুন ট্রেক হস্তান্তর দেশের পুঁজিবাজার প্রসারে এক নতুন সুচনা৷ এরই ধারাবাহিকতায় নতুন এবং পুরাতনদের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতায় রচিত হবে আগামীর পুঁজিবাজারের শক্তিশালী ভীত৷ তারল্য সংকটে শেয়ারবাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিনিয়োগ কার্যক্রমের মাধ্যমে বাজারকে স্বাভাবিক করার লক্ষে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিতরণ না হওয়া লভ্যাংশ নিয়ে শেয়ারবাজার স্থিতিশীলকরণ তহবিল গঠন করা হয়েছে৷

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আনুপাতিক হারে শেয়ার বরাদ্দের জন্য এক্সচেঞ্জে ইলেক্ট্রনিক সাবস্ক্রিপশন সিস্টেমের উদ্বোধন করা হয়৷ এর ফলে ইস্যুয়ার কোম্পানির আইপিও ইস্যু খরচ কমার পাশাপাশি, চাঁদা গ্রহণ থেকে লেনদেন শুরুর মধ্যবর্তী সময় কমে আসে৷ একইসঙ্গে আইপিও আবেদন, পরীক্ষণ এবং শেয়ার বরাদ্দের ক্ষেত্রে আরও বেশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয় এবং একই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সব ধরনের স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে৷

স্মল ক্যাপিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেনে শুরু : আইপিওর শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বরাদ্দের সিদ্ধান্ত৷ কোয়ালিফাইড ইনভেস্টর অফার বাই স্মল ক্যাপিটাল কোম্পানিজ রুলস, ২০১৮ এর আওতায় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে এ বছর প্রযুক্তিগত সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ৬টি কোম্পানি নিয়ে স্মল ক্যাপিটাল প্ল্যাটফর্মে লেনদেনের সূচনা উন্মোচিত হয়েছে। যেখানে বর্তমানে আটটি কোম্পানি লেনদেন করছে।

বছরজুড়ে পুঁজিবাজারে নতুন তালিকাভূক্তি : ২০২১ সালে প্রাথমিকগণ প্রস্তাব বা আইপিওতে আসা ১৩টি কোম্পানি ২৫৮৬ কোটি ৯ লাখ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়৷ সূত্রমতে, ২০২১-এ শেয়ারবাজারে নতুনভাবে তালিকভূক্ত হওয়া এসব কোম্পানির মধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির অনুকূলে তালিকাভূক্ত হয়েছে ৫টি কোম্পানি। আর ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতিতে বাজারে এসেছে ৮টি কোম্পানি।

১০৪৬ কোটি টাকার মধ্যে বুক বিল্ডিং পদ্ধতির পাঁচ কোম্পানিই বাজারে এনেছে ৭০০ কোটি টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলো হলো- বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার, ইনডেক্স এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, লুব-রেফ (বাংলাদেশ) লিমিটেড, মীর আক্তার হোসেন এবং এনার্জি প্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড।

আর ২০২১-এ ফিক্সড প্রাইজ পদ্ধতির আটটি কোম্পানি বাজারে এনেছে ৩৪৬ কোটি টাকার শেয়ার। কোম্পানিগুলো হলো- একমি পেস্টিসাইডস, সেনা কল্যাণ ইন্স্যুরেন্স, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, সোনালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, দেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, ই-জেনারেশন এবং তৌফিকা ফুডস অ্যান্ড এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।

এছাড়াও ওটিসি মার্কেট থেকে আসা ৪টি কোম্পানি মূল মার্কেটে পুনঃতালিকাভুক্ত হয়৷ যার পরিশোধিত মূলধন ১৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অপরদিকে ২০২০ সালে ১টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডসহ মোট ৯টি সিকিউরিটিজ ৬০০২ কোটি ৯ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত হয়। সব মিলিয়ে ২০২১ সাল পুঁজিবাজারে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একটি ইতিবাচক বছর বলেও মনে করেন বিনিয়োগকারীসহ সংশ্লিষ্টরা।