দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি খেলাপি ঋণে আটকে পড়ছে। আর্থিক খাতে অসংখ্য সুবিধা দিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না খেলাপি ঋণে। খেলাপি না হতে বিশেষ সুযোগ দেওয়ার পরও খেলাপি ঋণবেড়েই চলেছে সমান হারে। গেল বছর ২০২১ সালে আর্থিক খাতের ঋণখেলাপি নতুন রেকর্ড গড়েছে। গেল বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ছাড়িয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা।

ঋণখেলাপিকে আর্থিক খাতের ক্যানসার বলা হয়। শরীরের ক্যানসার শুরু থেকে চিকিৎসা করলে সুস্থ হয়। কিন্তু আর্থিক খাতে শুরু থেকে ঋণখেলাপি জানা গেলেও এ ক্যানসার আর সুস্থ হয় না। আর্থিক খাতের এ ক্যানসার সুস্থ না হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞদের দাবি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অন্যায় করে দেওয়া ঋণগুলোই খেলাপি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কমিশন খেয়ে বা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এবং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নামে-বেনামে ঋণ প্রদানের কারণেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ এখন সর্বোচ্চ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ৩৪টি নন-ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোর (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ বা মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা। এ সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ হলো খেলাপি।

অপরদিকে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া নানা সুবিধা ও খেলাপি না করার জন্য বিভিন্ন সুযোগ দেওয়ার পরেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নন-পারফর্মিং লোন ডিসেম্বর শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, একই সময়ের তুলনায় ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নন-পারফর্মিং লোনের হার ছিল ব্যাংকের চেয়েও বেশি। ব্যাংক খাতের তুলনায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঋণ ছিল নন-পারফর্মিং।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যালেন্স শিট থেকে নন-পারফর্মিং লোনের হিসাব লুকিয়ে রাখে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য ভালো দেখানোর জন্য। কিন্তু পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের তদন্তে এ অন্যায় উঠে আসে। এর কারণেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেওয়া ঋণ স্থগিতের সুবিধার পরও গেল বছর শেষে মন্দ ঋণের হার বেড়েছে।’

মহামারি করোনার শুরুতে ২০২০ সালের ২৪ মার্চ এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে খেলাপি না করার নির্দেশ দেয়। সে সময় অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলায় ঋণগ্রহীতাদের সহায়তা করার জন্যও বলা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ থেকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো গ্রাহককে খেলাপি করেনি।

একই সুবিধা পরবর্তীতে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ধিত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের অন্যতম ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সুবিধা বলবৎ ছিল। এখন সে সুবিধা আর নেই। তাই আমরা এখন ঋণ পুনরুদ্ধারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছি।’

ঋণ পুনরুদ্ধারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু ক্ষেত্রে ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি, এ ছাড়া আমরা ঋণের বিপরীতে রাখা সম্পদ বন্ধক বিক্রি করে ঋণ আদায় করছি।’

বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৪টি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ৫ থেকে ৬টি প্রতিষ্ঠান ভালো করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, ব্যাপক অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির কারণে এ খাতে মন্দ ঋণ জমা হতে থাকে। এদিকে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ক্রমাগত এ খাতে খেলাপির হার বেড়েই চলেছে।

তথ্য মতে, গেল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ হাজার ২৪৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। যা ছিল মোট বিতরণকৃত ঋণের ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ পরিমাণ ২০২১-এর সেপ্টেম্বরে ১১ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ১৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গেল বছরের শেষের ৩ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ২৫৯ কোটি টাকা।

বর্তমানে ৩৪টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৯টি প্রতিষ্ঠানের ১০০ কোটি টাকারও বেশি ঋণখেলাপি হয়েছে। বাকি ১৫টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ রয়েছে ১০০ কোটি টাকার নিচে। অব্যাহতভাবে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে নজরদারি বাড়ানোর দাবি বিশেষজ্ঞদের।

খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায় উদ্বেগ জানিয়ে সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক ধারা অনুযায়ী সম্পূর্ণ রাজনৈতিকভাবে নতুন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও এসব প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়ায় আর্থিক খাতে অনিয়মের জন্য কিছুটা হলেও দায়ী।’

তিনি আরো বলেন,‘ব্যাংকগুলোকে যেভাবে নজরদারি করা হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেভাবে নজরদারি করা হয়নি। সেই সুযোগে জনগণের টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করায় বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। সঠিক সুপারভিশন করা হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের বোঝা কমানো সম্ভব হতো।’