দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও (এনবিএফআই) ঋণের সুদহার বেঁধে দেওয়া হলে এ খাতের পেছনের সারির প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। হাতেগোনা কয়েকটি এনবিএফআই ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারবে না। ফলে এ খাতের আমানত সংগ্রহ আরও কঠিন হয়ে পড়বে।

এনবিএফআইগুলোর সংগঠন বাংলাদেশের লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন আশঙ্কার কথাই জানা গেছে। তারা বলছেন, আইডিএলসি, লঙ্কাবাংলা, আইপিডিসি, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিংয়ের মতো ভালো এনবিএফআইগুলো ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ঋণ দিচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংক যেখানে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়, সেখানে অনেক এনবিএফআই সাড়ে ৮ শতাংশ সুদেও ঋণ বা লিজ সুবিধা দিচ্ছে।

তবে নতুন এনবিএফআই বা দুর্বল এনবিএফআইগুলোর জন্য আমানত সংগ্রহ ও তা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারা আমানতের সুদ বেশি দিতে বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে ঋণ বা লিজ সুবিধারও সুদহার বেশি রাখতে হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নাজুক এনবিএফআইগুলোর পক্ষে নির্ধারিত সুদে ঋণ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিএলএফসিএ চেয়ারম্যান ও আইপিডিসি ফ্যাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম। কেননা, তারা পুরনো আমানত ফেরত দিতে পারছে না এবং বেশি সুদে সেই আমানত নবায়ন করে চলেছে।

গত রবিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদ সভায় ব্যাংকের মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সুদহার সর্বোচ্চ কত হবে সে বিষয়টি এখনো জানায়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানা গেছে এ খাতের ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১২-১৩ শতাংশে নির্ধারণ করে দেওয়া হতে পারে। এর ফলে এনবিএফআই’র আমানতের সুদহারও কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে।

মমিনুল ইসলাম বলেন, কয়েকটি দুর্বল এনবিএফআই’র কারণে এ খাতে যে আস্থার সংকট বিরাজ করছে তাতে আমানতের সুদ কমালে অনেক প্রতিষ্ঠানের আমানত হাতছাড়া হবে। এনবিএফআইগুলোর আমানতের সিংহভাগই আসে ব্যাংক থেকে। বর্তমানেই দুর্বল বা চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাওয়া এনবিএফআইগুলোর কাছ থেকে ব্যাংক তাদের আমানত তুলে নিতে চাচ্ছে। এনবিএফআইগুলো সেই আমানত ফেরত দিতে না পারায় ব্যাংকগুলো আমানতের সুদ বেশি চাচ্ছে। কখনো কখনো শুনেছি ১৪-১৫ শতাংস সুদ দিতে হচ্ছে আমানতে। তাহলে ঋণের সুদ স্বাভাবিকভাবেই ১৭-১৮ শতাংশ হবে।’

‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক এনবিএফআই ও ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসে দীর্ঘমেয়াদি একটি পরিকল্পনা করে এ বিষয়টির সমাধান করবে। যেসব ব্যাংক এনবিএফআইতে রাখা আমানতে অস্বাভাবিক সুদ নিচ্ছে তারা যাতে আমানত ফেরত নেওয়ার চাপ না দিতে পারে সেজন্য ৫ বছরে পরিশোধের একটি সিডিউল করে দিতে পারত কেন্দ্রীয় ব্যাংক’ যোগ করেন বিএলএফসিএ চেয়ারম্যান।

তিনি আরও বলেন, ‘এটা না করলে এনবিএফআইগুলো ব্যাংকের আমানত ফেরত দিতে পারবে না। কেবল বেশি সুদ আদায় করলে তো হবে না। আমানতও ফেরত নিতে হবে।’ ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের আগস্টে আমানতের সর্বনিম্ন হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নিতে বলা হয়। তবে এতদিন এনবিএফআইগুলোর ক্ষেত্রে এমন কোনো নির্দেশনা ছিল না।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ৫-৬টি এনবিএফআই বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অবসায়ন করা হয়েছে। রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের নাম পরিবর্তন করে আভিভা ফাইন্যান্স করা হয়েছে। একইভাবে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) ধুঁকে ধুঁকে চলছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার পালিয়ে রয়েছেন।

এসব কারণে গত কয়েক বছর ধরে এনবিএফআইগুলো কিছুটা আমানত সংকটে রয়েছে। গত এক বছরে এনবিএফআইগুলোর আমানতে কোনো প্রবৃদ্ধি ছিল না। উল্টো এ খাত থেকে ৯২৪ কোটি টাকা আমানত কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগৃহীত আমানতের স্থিতি ছিল ৪২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। অথচ ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এনবিএফআইগুলোর সংগৃহীত আমানত ছিল ৪৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। এনবিএফআইগুলোর আমানতের ৯৮ শতাংশই মেয়াদি আমানত। বর্তমানে দেশে এনবিএফআই’র সংখ্যা ৩৪টি। এর মধ্যে সবশেষ যুক্ত হয়েছে স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স ও মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স।

এই পরিস্থিতিতে ঋণের সুদহার বেঁধে দিলে আমানত আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিএলএফসিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অন্য কীভাবে এর সমাধান করা যায় সে বিষয়ে আবেদন জানাব।’