আবু আহমেদ: সরকার পুঁজিবাজারে যুগান্তকারী কোনো উদ্যোগ নিতে চাইলে ডিভিডেন্ড আয়ের ওপর বিদ্যমান ১০ শতাংশ করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হোক। ডিভিডেন্ডের ওপর ১০ শতাংশ ট্যাক্স চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচনায় নিলেই ভালো হয়। কারণ, এটা যখন বিনিয়োগকারীদের হাতে আসে তখন আরো ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়। অর্থাৎ মোট কর দিতে হচ্ছে ২৫ শতাংশ।

তাই সরকার যদি শেয়ারবাজারের জন্য যুগান্তকারী কোনো কিছু করতে চায় তাহলে ব্যক্তি পর্যায়ে ডিভিডেন্ড ইনকামের ওপর ১০ শতাংশ অ্যাড সোর্স কেটে নিচ্ছে ওইটাই চূড়ান্ত ঘোষণা করুক আর বলুক আপনাদের আর কর দিতে হবে না।

যারা কালো টাকার অধিকারী তারা অন্যক্ষেত্রে প্রেফার করে। টাকা হয়তো বিদেশে পাচার করা বা জমি-ফ্ল্যাট এগুলো কিনতে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। বড় বিনিয়োগকারী সিস্টেমেই তৈরি হয়ে বাজারে আসবে। তাদের জোর করে আনা যাবে না।

বড় বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য আইপিওতে কোটা রাখা হয়েছে। অথচ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা কোটা বলতে কিছুই পায় না। তবে বড় বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসতে পারে। তাদেরও তেমন কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

বর্তমানে শেয়ারবাজারের একটা উল্লেখযোগ্য সমস্যা হচ্ছে লিস্টিংয়ে ভালো কোম্পানির অভাব। যা আছে তার সংখ্যা খুবই কম। সুতরাং সরকারের এই বিষয়টা অ্যাড্রেস করা উচিত। ভালো কোম্পানি বাজারে আনতে কী কী করা দরকার এটা নিয়ে সরকারের ভাবা উচিত।

শ্রীলঙ্কা পাকিস্তান বিদেশি লোন এনে এনে তাদের ঋণের পাল্লা ভারী করেছে। আমার কাছে মনে হয়, বাংলাদেশ ওই পথ থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ বিদেশি লোন এটা খুবই খারাপ জিনিস। লোকাল লোন টাকাতে পেমেন্ট করা যায় কিন্তু বিদেশি লোন পেমেন্ট করতে হয় ইউএস ডলারে এবং এটা বার্ডেন সামহোয়্যার। তাই বাজেটের এই প্রস্তাবনায় এগুলোও একটু দেখা উচিত। এই ইস্যুটি সরকারকে অ্যাড্রেস করতে হবে।

২০ শতাংশের নিচে যারা আছেন তাদের কথা বিবেচনায় অন্তত আগামী এক বছর যেন টিসিবি সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য পেতে পারে তার জন্য বাজেটে একটা ব্যবস্থা রাখতে পারে। এটাকে উপজেলা পর্যন্ত নিতে হবে। ওপেন মার্কেট সেলে (ওএমএস) সরকারের তরফ থেকে এখানে কিছু ভর্তুকি লাগবে।

অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। আননেসেসারি যেটা চলবে না সেখানে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। সরকারি অনেকগুলো শিল্প কারখানা আছে যেগুলো চলবে না, কিন্তু তারপরও বছরের পর বছর সেখানে ভর্তুকি দিয়েই যাচ্ছে। ওই সমস্ত খাতে ভর্তুকি বন্ধ করে তা ২০ শতাংশের নিচে যারা গরিব আছে তাদের জন্য বরাদ্দ করতে হবে।

বরাদ্দের ক্ষেত্রে বাজেটে দ্বিতীয় স্বাস্থ্য খাত। তবে এই খাতে কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দগুলোর অপব্যবহারও হচ্ছে। এখানে একটা রেগুলেটরি কমিশন থাকা উচিত। এক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ খাতের অনিয়ম কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। যেকোনো লোকে সাইনবোর্ড নিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসছে। এগুলো কন্ট্রোল বা এর পারমিশন কে দিচ্ছে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লাইসেন্স ফি দিলেই লাইসেন্স দিয়ে দিচ্ছে যা কোনোভাবেই ঠিক নয়।

সরকার বাজেটের এই প্রস্তাবনায় এই প্রশ্ন তুলতে পারে যে, বরাদ্দগুলো অপব্যবহার হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অপব্যবহার হচ্ছে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে। তাই এখানে ফুল ফ্রেমে একটা ওয়াচ ডগ দরকার। করপোরেট আয়কর কমানোর বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউকে, ইউএসএ, আমাদের প্রতিবেশি ভারতেও করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমানো হয়েছে।

প্রতিযোগিতামূলক কাজ করতে গেলে কোম্পানিগুলো এত ট্যাক্স দিয়ে পারবে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কম দিলেও সাপ্লিমেন্টারী ডিউটি দিতে হচ্ছে সেগুলোর দিকেও নজর দেওয়া উচিত।

শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স গুরুত্বপূর্ণ। এখানে তালিকাভুক্ত হলে কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহিতার মধ্যে আসতে হবে। কোয়ার্টারলি রিপোর্ট দিতে হয়, অ্যানুয়াল রিপোর্ট দিতে হয় এবং এজিএম করতে হয়। এর মাধ্যমে অনেক স্বচ্ছতা আসে।

করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স সেক্টরের যে ইনকাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পাচ্ছে, তার ৮০ শতাংশ আসছে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে। নন-লিস্টেড মাল্টিন্যাশনাল ও দেশীয় ভালো কোম্পানি যেগুলো আছে তাদের আনতে হলে কিছু সুবিধা অবশ্যই দিতে হবে। আর এটি করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স কমানোর মাধ্যমে দেওয়া যেতে পারে।

আমি শুনেছি এবার ২.৫ শতাংশ নাকি কমাবে। কিন্তু নন-লিস্টেড কোম্পানির ক্ষেত্রে যদি ২.৫ শতাংশ কমায় তাহলে ব্যবধানটা ৭.৫ থাকে কেন? অথচ এর ব্যবধান এক সময় ১০ শতাংশ ছিল। গত দুই তিন বছর আগে ব্যবধান কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়ছিল, যেখানে ১০ শতাংশে ভালো কোম্পানি লিস্টিংয়ে আসতেছে না সেখানে ৭.৫ শতাংশে কেন আসবে?

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডার তারা বলেছে লিস্টেড কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স ৫ শতাংশ কমানোর জন্য এটা বিবেচনা নেওয়া যেতে পারে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের এখন ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডিভিডেন্ড ইনকাম ট্যাক্স ফ্রি আছে। যেটা ১৯৯৭-৯৮ এর দিকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ফ্রি ছিলো। কোনো ট্যাক্স দিতে হতো না। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা আবারো ১ লাভ টাকা করে দেওয়া হোক।

যেসকল কোম্পানি বেশি ডিভিডেন্ড দেয় তাদের একটা ট্যাক্স ছাড় দেওয়া যেতে পারে। দিন শেষে এখানে কোন কোম্পানি কত বেশি ডিভিডেন্ড দিচ্ছে সেটাই কিন্তু মানুষ দেখে। সুতরাং যারা বেশি ডিভিডেন্ড দেয় তাদের একটা ট্যাক্স ছাড় দেওয়া যেতে পারে।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক।