দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দুর্বৃত্তদের টার্গেট এবার রেললাইনে। তারা রেললাইনকে ঘিরে ছক কষছে। দেশকে অস্থিতিশীল করতেই এ ধরনের চক্রান্ত হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে তারা বুধবার ভোরে গাজীপুরে রেললাইন উপড়ে ফেলে। এতে রেল দুর্ঘটনায় একজন নিহত হন। আহত হন অনেকেই। ওই ঘটনার রেশ না কাটতেই বুধবার রাতে নীলফামারীতে রেললাইনের ৭২টি ফিসপ্লেট খুলে ফেলেছে দুর্বত্তরা। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পায় সীমান্ত এক্সপ্রেস। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ২৬ জেলায় নতুন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। সেখানে পুলিশি টহলের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে।

স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে যে কোনো অপ্রীতিকর ও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে। এছাড়া রেল মন্ত্রণালয় থেকে বাড়তি ফোর্স চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। ওই চিঠি যাচাই-বাছাই করে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানা গেছে।

পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, সড়কে র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক টহলের কারণে দুর্বৃত্তরা কোনো ধরনের নাশকতা ঘটানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এ কারণে তারা রেললাইনকে বেছে নিয়েছে। রেললাইনে সাধারণত কোনো টহল থাকে না। নিয়মিত টহল দেয়ার সুযোগও খুব কম। এ কারণে নির্জন স্থানের রেললাইনে নাশকতার জন্য ফিসপ্লেট খুলে ফেলা বা রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে।

তবে দুটি ঘটনার পর দেশের বিভিন্ন স্থানের রেললাইনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আনসার সদস্যদের উপস্থিতিও। এছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গতিতে রেল চালানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। সূত্র মতে, দুটি ঘটনার পর সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দেশের ২৬ জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

যাতে কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা কোনো ধরনের ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালানো মাত্র তাকে আইনের আওতায় আনা যায়। এছাড়া ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অন্য কোনোভাবে কেউ যাতে কোনো গুজব ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারেও পুলিশের সাইবার ইউনিটকে সতর্ক করা হয়েছে।

বাড়তি নিরাপত্তা নেয়া জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, যশোর, কুমিল্লা, বি.বাড়িয়া, ফেনী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পাবনা, বাগেরহাট, মাগুরা, পঞ্চগড়, রংপুর, সৈয়দপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, কুষ্টিয়া ও নরসিংদী।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১০ দিন এ বাড়তি সতর্কতা চলমান থাকবে। এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে ধাপে ধাপে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি কমিয়ে আনা হবে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক অনুমেয় না হলে বিশেষ সতর্কতার মেয়াদ আরও বাড়বে।

গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, রেললাইন দেখভালের দায়িত্ব রেল পুলিশের। তারপরও জেলা পুলিশ সন্দেহভাজনদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রেখেছে। প্রতিটি থানাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা কাজ করছেন। একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের তথ্যানুযায়ী, জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা তত বেশি অপতৎপরতা শুরু করেছে।

সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের কাছ থেকে দেশে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির বিভিন্ন পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বুধবার রাত ১০টার দিকে নীলফামারীর ডোমারে রেললাইনের ফিশপ্লেট ক্লিপ খুলে নাশকতার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। তবে এলাকাবাসী এগিয়ে আসায় বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে চিলাহাটি-খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন। ডোমারের বোড়াগাড়ি ইউনিয়নের বাগডোকরা গ্রামের প্রধানপাড়ার দোলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয়রা জানান, বুধবার রাতে ওই এলাকায় রেললাইনের লোহালক্কড় খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে যান। এ সময় তারা দেখতে পান, একদল দুর্বৃত্ত রেললাইনের ফিশপ্লেট ক্লিপ খুলছে। স্থানীয় লোকজন দলবদ্ধ হয়ে ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যায়। এ সময় ৭২টি ফিশপ্লেট ক্লিপ উদ্ধার করা হয়।

বাগডোকরা গ্রামের যুবক রাজেশ্বর রায় বলেন, এ সময় চিলাহাটি থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি আসছিল। এ সময় ঘটনাস্থলে ৩০০ থেকে ৪০০ লোক উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই বিভিন্নভাবে সংকেত দিতে থাকলে ট্রেনটি থামান চালক। এতে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় ট্রেনটি।
বোড়াগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, এলাকাবাসী ধাওয়া করলে দুষ্কৃতকারীরা পালিয়ে যায়। পরে তাদের ফেলে যাওয়া একটি বস্তা থেকে ৭২টি ফিশপ্লেট ক্লিপ উদ্ধার করা হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যে আসা খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটিকে এলাকাবাসী বিভিন্ন সংকেত দিয়ে থামাতে সক্ষম হন। এরপর রেলের লোকজন এসে রেললাইন মেরামত করলে ট্রেনটি ছেড়ে যায়।

জোড়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন, ‘ঘটনাটি আমার ইউনিয়নের সীমানায় ঘটেছে। আমি গিয়ে রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে ফিশপ্লেট ক্লিপ খোলা দেখতে পেয়েছি। এলাকাবাসীর সচেতনতায় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে ট্রেনটি।’ নীলফামারীর স্টেশনমাস্টার ওবায়দুর রহমান বলেন, লাইন মেরামত করা হলে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ট্রেনটি সেখান থেকে ছেড়ে আসে।

অপর দিকে রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা বরেন্দ্র এক্সপ্রেস টেনটিও দেড় ঘণ্টা আটকা পড়ে ডোমার রেলস্টেশনে। স্থানীয়রা যদি এ ঘটনা না দেখতেন তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। জানা গেছে, নীলফামারীর ঘটনার দিন ভোরে গাজীপুরের ভাওয়াল রেলস্টেশনের কাছে জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ রেলপথে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এ ঘটনায় এক যাত্রী নিহত এবং অন্তত ১০ জন আহত হন। এতে থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। নিহত ব্যক্তি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার রওহা গ্রামের আসলাম হোসেন।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মুহাম্মদ সফিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, নাশকতা সৃষ্টির জন্য দুর্বৃত্তরা রেলপথের একটি অংশ কেটে রেখেছিল। ট্রেনটি ওই স্থানে পৌঁছলে ইঞ্জিন ও চারটি বগি লাইনচ্যুত হয়।

এলাকাবাসী ও রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেন, যাত্রীবাহী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরের দিকে যাচ্ছিল। রাতের কোনো এক সময় দুর্বৃত্তরা গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর ও ভাওয়াল রেলস্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে বনখড়িয়া এলাকায় রেলপথের একটি অংশ কেটে রাখে। এরপর রাত সোয়া ৪টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি রাজেন্দ্রপুর স্টেশন পার হয়ে ভাওয়াল রেলস্টেশনে পৌঁছানোর আগেই লাইনচ্যুত হয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই একজন যাত্রী মারা যান। আহত অন্তত ১০ জনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে আশপাশের ক্লিনিকে নিয়ে যান।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুরে রেল দুর্ঘটনায় দুটি তদন্ত টিম কাজ করছে। এ ঘটনার পরিকল্পনাকারীসহ সবাইকে চিহ্নিত করে শিগগিরই ধরতে পারব। রেললাইন উপড়ে ফেলা অত্যন্ত দুঃখজনক জানিয়ে তিনি বলেন, যারা দেশকে ভালোবাসে তারা এ কাজটি করতে পারে না।

সারা দেশে হাজার, হাজার কিলোমিটার রেললাইন। এরা যেখানে নাকি মানুষ থাকে না, সেই জায়গায় টার্গেট করে তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। রেল মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দিয়ে আরও ফোর্স চেয়েছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে রেল পুলিশে লোকবল বাড়ানো প্রয়োজন হলে নিশ্চয়ই করা হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২০১৪ সালে অগ্নিসন্ত্রাসের সময়ও রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছিল। জানমালের ক্ষতি তো হয়েছে, নিরীহ মানুষকেও হত্যা করা হয়েছে। সে সব দৃশ্য সবাই দেখেছেন। এবারও আমরা সেটি লক্ষ্য করছি। তারা শুধু গাড়িতে অগ্নিসংযোগ দিচ্ছে না, রেললাইনও উপড়ে ফেলেছে। বুধবারের ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন এবং সাতজন গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন।
নাশকতারোধে রেল চালু করল ‘ট্রলি রান’ ব্যবস্থা: রেললাইনে নাশকতা ঠেকাতে ‘ট্রলি রান বা অ্যাডভান্স পাইলট’ ব্যবস্থা চালু করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। গাজীপুরে রেললাইন কেটে দেয়ার পরদিন বৃহস্পতিবার থেকে এ ব্যবস্থা পুরোদমে চলছে বলে জানিয়েছেন রেলের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘নাশকতার বিষয়টি নিয়ে আমরা খুব উদ্বিগ্ন।

রাতের বেলায় আমরা বেশি শঙ্কিত। সারা দেশে ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটারের বেশি রেললাইন। প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং নদী, খাল, বিলের পাশ ও উপর দিয়ে রেললাইন গেছে। যার কারণে পুরো এলাকা পাহারাদার বসানো সম্ভব নয়। সামর্থ অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সার্বক্ষণিক পাহারা এবং ‘অ্যান্ডভান্স পাইলট সিস্টেম’ চালু করা হয়েছে।’

নাশকতার ঝুঁকি বিবেচনা করে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে নাজমুল বলেন, তার মধ্যে একটি অ্যাডভান্স পাইলট সিস্টেম বা ট্রলি রান। রেল যাওয়ার আগে একটি ইঞ্জিন বা ট্রলি গিয়ে রেললাইন ঠিক আছে কিনা তা দেখে নেয়, যেটিকে অ্যাডভান্স পাইলট সিস্টেম বলা হয়ে থাকে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে দেশজুড়ে নাশকতা হয়েছিল।

তখন দেশের বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ানো, ফিশপ্লেট খুলে ফেলা, আগুন দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছিল। সে সব ঘটনায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছিল; তখন একই ধরনের ‘অ্যাডভান্স পেট্রোলিং ট্রেন’ চালু করা হয়েছিল।