দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইভিএমে নয়, ব্যালটের ম্যধ্যমে করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সরকারের কাছে ইসি অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। ইসি ভোট গ্রহণে প্রযুক্তির ব্যবহারের স্বপ্ন দেখলেও দেশের অর্থনৈতিক কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সরকার এ প্রকল্পে নতুন করে আর কোনো টাকা দিতে চাচ্ছে না। আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোরও কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে ইভিএমের জন্য সরকার নতুন করে কোনো প্রকল্প নেবে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানা যায়, প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর আগে দেড় লাখ ইভিএম ক্রয় করে নির্বাচন কমিশন। এ সময়ে প্রায় এক হাজার ২০০ ভোট হয়েছে এসব মেশিন দিয়ে। এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি ইভিএম নষ্টও হয়ে গেছে। সেগুলো সংস্কার করার জন্য বরাদ্দ চেয়েছিল ইসি। না পাওয়ায় ইভিএমের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত কমিশন।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে তিন হাজার ৮২৫ কোটি টাকায় দেড় লাখ ইভিএম কেনা হয়। গত সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট হয়েছিল। এবার ১৫০ আসনে ব্যবহার করতে চেয়েছিল ইসি। এ লক্ষ্যে দুই লাখ ইভিএম কিনতে আট হাজার ৭১১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল কমিশন। কিন্তু একনেক সে প্রকল্পে অনুমোদন দেয়নি। আর হাতে থাকা ইভিএম মেরামতের জন্য চাওয়া হয়েছিল এক হাজার ২৫৯ কোটি টাকা। সে টাকাও মেলেনি। ফলে বাধ্য হয়ে প্রকল্পই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।

ইভিএম প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেন, ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এর আগেই প্রকল্পের ইভিএম ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো কমিশনকে বুঝিয়ে দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৭৫ হাজার ইভিএম নষ্ট হয়ে গেছে। মেরামতের জন্য টাকা না পাওয়ায় বাকিগুলোও অকেজো হওয়ার পথে।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ইলেক্ট্রনিক জিনিসের একটি আয়ু আছে। সে আয়ু থাকার মধ্যেই অনেকগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। যেগুলোকে নতুন করে মেরামত করা সম্ভব হবে না। আবার অনেকগুলো মেয়াদের পরও কার্যকর থাকে। সেগুলো যতটুকু পারা যায় মেরামত করে যে কয়দিন চালানো যায়।

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন মিলে প্রায় এক হাজার ২০০ ভোট ইভিএমে হয়েছে। ভোট দিয়েছেন প্রায় চার কোটি ভোটার। এ ছাড়া, প্রায় চার লাখ জনগোষ্ঠী প্রশিক্ষণ নিয়েছে। অথচ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার হচ্ছে না। তাহলে যে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হলো সেটা কি শুধুই অপচয়?
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, বড় বড় রাজনৈতিক দল যদি চায় ইভিএমে নির্বাচন হবে তাহলে আবার ইভিএমের ট্রেন্ডার হতেও পারে। সেগুলো নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের পর আমরা চিন্তা করব।

এদিকে, বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থেকে পুরোপুরি সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আসন্ন নির্বাচনে ব্যালট পেপারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণায় অনেকে বেশ অবাকও হয়েছেন। তবে কিছু আসনে ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কমিশন অনড় মনোভাব দেখালেও আকস্মিকভাবে তারা পুরোপুরি সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইভিএমে নির্বাচনের পক্ষে থাকলেও বরাবরই এতে আপত্তি জানিয়েছিল বিরোধী দলগুলো।

এ বিতর্কের মধ্যেই ১৫০ আসনে ইভিএমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল নির্বাচন কমিশন। নতুন ইভিএম মেশিন কিনতে এবং পুরাতন ইভিএম মেরামতের জন্য সরকারের কাছে টাকা বরাদ্দও চেয়েছিল। কিন্তু এরপরই নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তারা ইভিএমে নয়, ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপারে ভোট হবে।

কেন এ সিদ্ধান্ত? নির্বাচন কমিশন ইভিএমে ভোটগ্রহণ করার জন্য টাকা বরাদ্দ চাইলে তা অনুমোদন না পাওয়ায় নির্বাচন কমিশনের সভায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

ইভিএমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কারণ হিসেবে নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয় ওই টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ইভিএমগুলো কিউসি (কোয়ালিটি চেকিং) করে কাজ করার মতো অর্থ ইসির হাতে নেই এবং এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।’ ইভিএম থেকে সরে আসার বিষয়টি শুধুই কোনো আর্থিক ব্যাপার নয়।

এর সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ও জড়িত আছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের কথার মধ্যেও সেটি আঁচ করা করা যায়। কমিশনের সচিব জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে বিভেদ তৈরি হয়েছে, সেটাও নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তে প্রভাব রেখেছে।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে সময় স্বল্পতা ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ পেতে অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে- এসব বিষয় বিবেচনা করে নির্বাচন কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ জানা গেছে, বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ব্যবহারের মাধ্যমে এ ইভিএম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এরপর বিভিন্ন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হলেও এটি নিয়ে কখনই পুরোপুরি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ইভিএমে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ না পেয়েই মূলত ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে নির্বাচন কমিশন। তিনি বলছেন, ‘হুট করে যে এ সিদ্ধান্তটা হলো, এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু সেটা সরকারও বলবে না, ইসিও বলবে না। কারণ সেটা বললে, তারা যে বলে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা স্বীকার করবে না। কিন্তু বোঝা যায় এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা সমাবেশ থেকে বিএনপি যে ১০ দফা দাবি জানিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ইভিএমে বাতিল ও ব্যালট পেপারের মাধ্যমে ভোটের ব্যবস্থা করা।

নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমাদের প্রধান দাবি হচ্ছে কেয়ারটেকার সরকার বা নির্দলীয় একটা সরকার, এরপর পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার প্রসঙ্গ। তারপর নির্বাচন কমিশন। ব্যালটের ভোটের প্রসঙ্গটি আমাদের কাছে খুব বড় প্রসঙ্গ না। বড় কথাটি হচ্ছে নির্দলীয় সরকার, তারপরে অন্যান্য প্রসঙ্গ। সেই কারণে ব্যালটের বিষয়টি তারা সামনে এনে প্রধান নির্দলীয় সরকারের প্রসঙ্গটি (সরকার) আড়াল করতে চাইছে বলে আমাদের ধারণা।’

অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘মানুষ যদি ভোটই দিতে না পারে, তাহলে ব্যালট অথবা ইভিএম কোনো প্রসঙ্গ না। প্রধান প্রসঙ্গ হচ্ছে ভোটের ব্যবস্থা করা। সেই ভোটের ব্যবস্থা যদি আমরা করতে পারি, তখন যদি ব্যালটের প্রসঙ্গ আসে, তাহলে এটি যৌক্তিক একটা ঘটনা হয়ে দাঁড়াবে, তার আগে না’।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিলেও এখানে আসলে সরকারের সম্মতি পেয়েই তারা এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ যেখানে সরকারি দলের পক্ষ থেকেই ৩০০ আসনে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছিল, সেখানে কোনো আলোচনা ব্যতিরেকেই ক্ষমতাসীন দলের সম্মতি এবং গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া সব আসনে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের নেয়ার কথা হয়। এদিকে গত বছর জুন মাসে যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংলাপ শুরু করে, তখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল কমিশনে গিয়ে সব আসনে ইভিএমে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এসেছিল।

সেই সংলাপে বিএনপি না গেলেও তারা ইভিএমে ভোটগ্রহণের ব্যাপারে শুরু থেকেই আপত্তি প্রকাশ করেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনে করে, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক সংস্থা, তারা যেটি যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন, তারা সেভাবে করেছেন।

৩০০ আসনে ইভিএমে নির্বাচনের যে দাবি জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ, সেখান থেকে নির্বাচন কমিশন সরে আসার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ কীভাবে দেখছে এমন জিজ্ঞাসায় আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া বলেন, ইভিএমে নির্বাচন করার ক্ষমতা আছে নির্বাচন কমিশনের। সেক্ষেত্রে তারা ইভিএমে নির্বাচন আয়োজন করলে ভালো হতো। কিন্তু যেহেতু নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, তারা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি আমরা গ্রহণ করেছি।’

তিনি বলেন, ‘এখন বিএনপি বলছে, ব্যালটে নির্বাচন হবে, সেটাও নাকি আমরা চাইছি এ কারণে। বিএনপি আসলে চিরাচরিতভাবে সবকিছুতেই তারা আওয়ামী লীগকে যে দোষারোপ করে, তার একটি প্রমাণ হচ্ছে এটা’।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বরাবরই বলে আসছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নয়, সংবিধান অনুযায়ী দেশে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই সাধারণ নির্বাচন হবে। তবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে।

এ বিতর্কের মধ্যেই ইভিএমে ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে নির্বাচন কমিশন সরে আসার সিদ্ধান্ত জানায়। কিন্তু তাতে সংকটের তেমন কোনো সমাধান হয়নি বলে মত বিশ্লেষকদের। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, ইভিএমে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীনরা অগ্রসর হতে চায়নি। বিশেষ করে বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় সরকার মনে করেছে যে, এ মুহূর্তে এই টাকাটা অপচয়মূলক। আমি মনে করি, সরকার সেই সিদ্ধান্তটা খুব ভালোভাবেই নিয়েছে এবং ইসি সেটা শুধুমাত্র জানিয়ে দিয়েছে।’

তিনি বলেন, এতে আসলে নির্বাচন নিয়ে সংকটের তেমন কোনো সমাধান মেলেনি। কারণ আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে বিএনপি- যারা ইভিএম নিয়ে সোচ্চার ছিল, তাদের মূল দাবি নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন না হওয়ার সংকটটা থেকে যাওয়ায় আসন্ন সংসদ নির্বাচন ইতোমধ্যেই বর্জন করেছে বিএনপি।

নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে সময়। এজন্য ইভিএম মেরামতের জন্য সরকারের কাছে টাকা চেয়েছিল ইসি। ওই টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায় ইসি সিদ্ধান্ত নেয়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই স্বচ্ছ ব্যালট পেপারে ভোট অনুষ্ঠিত হবে।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান রয়েছে। দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শেষে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা নিয়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। তবে ইভিএম কেনার প্রকল্পে সরকারের সায় না পাওয়ায় ইসির প্রস্তাবিত প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়।