আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের পরও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ায় দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে হতাশা ভর করছে। এই হতাশা দূর করতে চায় দলটি। এ জন্য বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। সে ক্ষেত্রে ১২ অথবা ১৩ ফেব্রুয়ারি লিফলেট বিতরণের মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরু করার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এসএসসি পরীক্ষা মাথায় নিয়ে এ কর্মসূচি সাজানো হবে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষনেতারা কর্মসূচির পাশাপাশি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটি পুনর্গঠন শুরু করার প্রস্তাব দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভায় দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় নতুন কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে কারাবন্দি ও বিভিন্ন মামলার আসামি হওয়া ফেরারি নেতাকর্মীদের মুক্ত জীবনে ফিরিয়ে আনতে আইনি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে বাড়তি গুরুত্ব দিতে সংশ্লিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার ইতিহাস দীর্ঘ হচ্ছে বিএনপির। দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪, ১৮ এবং এবার দ্বাদশ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েও আন্দোলন সফল করতে পারেনি দলটি। অনেকের মতে, এবারের আন্দোলন ২০১৪ সালের মতোও জমাতে পারেনি তারা। এজন্য দলের মধ্যে থাকা একটি সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন নেতাকর্মীদের অনেকেই। আন্দোলনে ব্যর্থতা প্রসঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, কর্মীরা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়নি। তারা জীবনবাজি রেখে মাঠে ছিল। এ আন্দোলনে নিঃস্ব হয়েছে অসংখ্য নেতাকর্মী।

তারা বলছেন, সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করার পর কেন নির্বাচন বর্জনের জন্য জনগণের মাঝে লিফলেট বিতরণ করে একদফা আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলো? একদফার মধ্যে তো লিফলেট বিতরণ বা গণসংযোগের কথা ছিল না। দলে থাকা একটি সিন্ডিকেট ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভুল বুঝিয়ে অন্ধকারে রেখেছে। যার খেসারত দিতে হয়েছে নেতাকর্মীদের। এই সিন্ডিকেট চিহ্নিত হলেও ভয়ে মুখ খুলছে না অনেকেই।

তারা বলছেন, এই সিন্ডিকেট কতটুকু চতুর হলে লিফলেট বিতরণ করে হাইকমান্ডকে বুঝিয়েছে ভোটাররা লিফলেট বিতরণে সাড়া দিয়ে ভোট দিতে যাননি। এসব করে তারা বিভিন্নভাবে আর্থিক ফায়দা লুটেছে বলেও অভিযোগ করেন অনেক নেতাকর্মী। অভিযোগ তুলেছেন কমিটি বাণিজ্যেরও। কাক্সিক্ষত আন্দোলনে সফলতা পেতে হলে আগে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সিন্ডিকেটমুক্ত হতে হবে বলে জানান তারা।

কারা এই সিন্ডিকেটের হোতা, এমন প্রশ্নে সরাসরি সিন্ডিকেট সদস্যদের নাম না বললেও তারা বিশেষ ইঙ্গিত দিয়েছেন। বলেছেন, সিন্ডিকেটের একজন দেশের বাইরে আছেন। আরেকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য, যিনি দেশেই আছেন। এছাড়া মধ্যম সারির এক প্রভাবশালী নেতাও রয়েছেন সিন্ডিকেটে, যার কাছে স্থায়ী কমিটির কোনো কোনো সদস্যকেও ধরনা দিয়ে দেখা যায়।

এদিকে ২০২২ সালের আগস্ট থেকে সারা দেশে সরকারবিরোধী একটানা আন্দোলন করে আসছে রাজ পথের সব চেয়ে বড় দল বিএনপি। আন্দোলন শুরু থেকেই নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া পেয়েছে দলটি। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘চূড়ান্ত’ পর্যায়ে এসে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে আন্দোলন। কারণ হিসেবে বিএনপির হাইকমান্ডের ‘সুপার ফ্লপ’কেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। এ নিয়ে নির্বাচনের পর দলের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশে সংঘাতকে কেন্দ্র করে প্রশাসন কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে মাঠ ছেড়ে চলে যান দলের নেতাকর্মীরা। চালকের আসন থেকে ব্যাকফুটে চলে যায় বিএনপি। এরপর ২৯ অক্টোরব থেকে লাগাতার আন্দোলনে যায় বিএনপি। সমমনা দলগুলো নিয়ে ১২ ধাপে ২৪ দিনের অবরোধ এবং পাঁচ ধাপে ছয় দিনের হরতাল পালন করে দলটি। এতে রাজধানীসহ সারা দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায়নি।

সূত্র জানায়, ঢাকায় মহাসমাবেশ চলাকালে যখন বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বক্তব্য দেয়ার সময় অ্যাকশনে যায় প্রশাসন। এমন পরিস্থিতিতে মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় বিএনপি নেতাকর্মীরা। তখন হ্যান্ড মাইক দিয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন মির্জা ফখরুল। মঞ্চ থেকে নেমে যাওয়ার সময় তাকে হরতালের ঘোষণা দেয়ার জন্য বারবার চাপ দেন অন্য নেতারা। তখন মির্জা ফখরুল ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেন। এরপর একে একে বিএনপির সিনিয়র নেতারা নিরাপদে সরে যান। কিন্তু ইচ্ছা করলেই পরিস্থিতি শান্ত করতে পারতেন সিনিয়র নেতারা। তারা মঞ্চ থেকে নেমে সামেনে গিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বললে এমন পরিস্থিতি নাও হতে পারত বলে মনে করেন অনেকে।

২৯ অক্টোবর থেকে নির্বাচন পর্যন্ত টানা হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিলেও উত্তাপ ছড়াতে পারেনি বিএনপি। যদিও দলটির নেতাদের দাবি— সরকারের নানা নির্যাতন, হামলা, মামলার কারণে নেতাকর্মীরা মাঠে নামতে পারেনি। তবে আন্দোলনে ব্যর্থতা নেতাদের পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়িয়েছে। বিশেষ করে গত ২৮ অক্টোবরের পর দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরুসহ অনেক নেতাকর্মী কারাবন্দি হন। এরপর গ্রেপ্তার আতঙ্কে কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের বড় অংশটি আত্মগোপনে চলে যায়। রুহুল কবির রিজভী ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রকাশ্যে কর্মসূচিতে তেমন দেখা যায়নি।

জানা গেছে, ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করতে কী কী পরিকল্পনা নেয়া দরকার সেটা নিয়ে হোমওয়ার্ক করেনি বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা। এছাড়া সরকার কী কৌশল নিচ্ছে সেটাও জানার চেষ্টা করেননি দলটির হাই কমান্ড। নেয়া হয়নি একাধিক পরিকল্পনা। এক সপ্তাহ আগেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট করে বলছিলেন হেফাজতের যে পরিণতি হয়েছিল সেটার জন্য বিএনপিকে অপেক্ষা করতে হবে।

সারা দেশ থেকে আসা লাখ লাখ নেতাকর্মীর শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে দল থেকে কোনো স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেয়া হয়নি। সমাবেশের পরিধি যখন ধারণাতীত এলাকা ছাড়িয়ে যায় তখন আর শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারেনি দলটি।

বিএনপির অতীতের আন্দোলন সংগ্রামে কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল নেতাদের যথেষ্ট অভিযোগ ছিল। এবারও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলন করলেও আওয়ামী লীগকে একতরফা নির্বাচন করতে না দেয়ার ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আত্মগোপনে থেকে হরতাল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও রিজভীকে ছাড়া প্রকাশ্যে কোনো নেতাদের ভূমিকা চোখে পড়েনি।

যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী নির্বাচন বয়কট করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব জায়গায়ই গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন আত্মগোপনে। রাজনৈতিক সংকটে নেতাদের অনুপস্থিতি ভালোভাবে নেয়নি তৃণমূল। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

বিএনপির কয়েকটি জেলার নেতারা বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত সব কর্মসূচি সফল করার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে থাকি। প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অত্যাচার নির্যাতনের মধ্যেও নেতামর্কীরাও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করে থাকে। জেলাগুলোতে যেভাবে আন্দোলন হয় সেভাবে ঢাকাতে আন্দোলন হচ্ছে না। আমাদের কষ্ট হচ্ছে ঢাকায় আন্দোলন হয় না। ঢাকায় জোরালো আন্দোলন হলে ৭ জানুয়ারি নির্বাচন সম্পূর্ণ করতে পারত না। ঢাকায় আন্দোলন জোরদার করার জন্য আমারা কেন্দ্রীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছি।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে সারা দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে বিএনপি। এর মধ্যে একাধিকবার দলটির কর্মসূচিতে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। ওই সময় অনেক হামলা, বাধা, প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দলটি সারা দেশে বিভাগীয় পর্যায়ে বড় বড় সমাবেশ করে কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করে। আন্দোলনে প্রথম ধাক্কা আসে ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর, ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশের কর্মসূচি নিয়ে। ঢাকার সমাবেশ নয়াপল্টনে করার জেদ ধরে বিএনপি।

এ নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিলে নয়াপল্টনে পুলিশের গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের একজনের মৃত্যুসহ অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হন। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আরও সাত মাস সময় লাগে দলটির। সারা দেশে নতুনভাবে কর্মসূচি পালন করে দ্বিতীয় দফায় গত বছরের ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশ করে দলটি। ওই মহাসমাবেশ থেকে পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়। এতে প্রথম সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায়। যার কারণে আগের দিন মহাসমাবেশে লাখো মানুষের জমায়েত হলেও পরদিনের অবস্থান কর্মসূচিতে কয়েক হাজার নেতাকর্মীও উপস্থিত করতে পারেনি বিএনপি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ২৯ জুলাইয়ের ব্যর্থতার ওই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে নতুন করে একেবারে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় পর্যন্ত তিন মাস ধরে দফায় দফায় নানা কর্মসূচি করতে হয়। আন্দোলন চূড়ান্ত ধাপে নিতে ২৮ অক্টোবর আবার ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হয়। কিন্তু সংঘাত ও সহিংসতায় পড়ে সেই মহাসমাবেশ পুলিশের অভিযানে পণ্ড হয়ে যায়। মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর বিএনপি এবং জোটের শরিকদের মধ্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা হয়। তাদের অভিযোগ, মহাসমাবেশ ঘিরে বিএনপির নেতৃত্বের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, আন্দোলন যতটা করার দরকার ছিল ততটাই করা হয়েছে। আমাদের আন্দোলন থামেনি, এখনো চলছে। কদিন আগেই তো কর্মসূচি পালন করার সময় আমাদের নেতা মঈন খানসহ মহিলা দলের নেতাদের পুলিশ হেনস্তা করেছে। শেখ হাসিনা আন্দোলনে ভয় পেয়ে দমনপীড়ন করেছে। এজন্য পরিকল্পিত ভাবে ২৮ অক্টোবর সমাবেশকে পণ্ড করে দিয়েছে। আন্দোলন না হলে ২৫ হাজার বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হলো কেন।