মোঃ সিরাজুল মনির, চট্টগ্রাম, দেশ প্রতিক্ষণ: সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের সরকারি বিধিবিধান লঙ্ঘন, অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করা, প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ফি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা প্রদান না করা, এক খাতের ব্যয় অন্য খাতে ব্যয় করা, সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে হওয়া সত্ত্বেও কর্মচারীদের যাতায়াত ভাতা প্রদান করাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও অসঙ্গতির জন্য অডিট আপত্তি দিয়েছে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) এসব অসঙ্গতি ও অনিয়মের জন্য ৪২টি অডিট আপত্তি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। এতে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার অনিয়মের কথা উঠে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত সর্বশেষ ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেক অডিটেই এসব অনিয়ম, অসঙ্গতির তথ্য আসে।

স্বায়ত্তশাসন থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মতো করে অনিয়ম করে যাচ্ছে। তাদের দাবি, স্বায়ত্তশাসন শুধু একাডেমিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, আর্থিক নয়। এভাবে জনগণের টাকার অসঙ্গত ব্যবহার কারও কাম্য নয়।

তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মোট ৪২ অডিট আপত্তি দিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর, যার মধ্যে ২৯টি অডিটে অগ্রিম আপত্তি এবং ১৩টি অডিটে সাধারণ আপত্তি করা হয়। অগ্রিম ও সাধারণ আপত্তি মিলিয়ে ২৯টি অডিট আপত্তিতে আপত্তির সাল হিসেবে ২০১৭-২০২০ উল্লেখ করা হয় এবং অবশিষ্ট ১৩টি আপত্তিতে ২০২০-২০২১ উল্লেখ করা হয়। এসব আপত্তিতে জড়িত টাকার পরিমাণ ১৬৯ কোটি ৫৫ লাখ ৭৯ হাজার টাকা।

জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অডিট আপত্তিগুলো দেওয়া হয়, তার অধিকাংশই গুরুতর আর্থিক অনিয়ম, যার ধরন হিসেবে অগ্রিম উল্লেখ করা হয়েছে। আপত্তিগুলোর ক্ষেত্রে সাধারণত সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব আপত্তির ক্ষেত্রেও একই ধরনের সুপারিশ করেছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বিধিবহির্ভূতভাবে শিক্ষকদের প্রাপ্যতার অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা প্রদান, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করা সত্ত্বেও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন বিল থেকে নির্ধারিত হারে বাড়ি ভাড়া কর্তন না করা, পদ ছাড়াই অর্গানোগ্রামবহির্ভূত বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে শিক্ষকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানপূর্বক দায়িত্ব ভাতা প্রদান, ডিজিটাল লাইব্রেরি সেবার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সরকারের অনুদান মঞ্জুরি থেকে ইউজিসি কর্তৃক অনিয়মিতভাবে কর্তন, সরকারি অর্থে বাস্তবায়িত প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না করা,

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিধিবহির্ভূতভাবে প্রাপ্যতার অতিরিক্ত বই ভাতা প্রদান করা, দোকান ও মার্কেট ভাড়া বাবদ অনাদায়ী অর্থ আদায় না করা, নির্ধারিত চাকরিকাল শেষ হওয়ার পরও সেশন বেনিফিটের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিধিবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত সময়ের চাকরির সুযোগ প্রদান করে বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করা, প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার ফি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলে জমা প্রদান না করা, সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে হওয়া সত্ত্বেও কর্মচারীদের যাতায়াত ভাতা প্রদান,

সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রাপ্য হার অপেক্ষা বেশি হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদান করা, ইউজিসির নির্দেশনা লঙ্ঘন করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা রাজস্ব বাজেট থেকে প্রদান করা, আর্থিক ক্ষমতাবহির্ভূত গাড়ি মেরামত বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় করা, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অনিয়মিতভাবে সময় বাড়িয়ে ঠিকাদারকে সুবিধা প্রদান,

প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অনিয়মিতভাবে বিল পরিশোধ, পিপিআর ২০০৮ লঙ্ঘন করে আরএফকিউ পদ্ধতিতে সিলিং অতিরিক্ত অনিয়মিত ব্যয় ৪২ লাখ ৬৩ হাজার ১০৬ টাক, প্রাপ্যতাবহির্ভূতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণির কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অধিককাল/ওভারটাইম ভাতা প্রদান করাসহ ৪২টি খাতে প্রায় ১৭০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির জন্য অডিট আপত্তি দেখিয়েছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে ইউজিসির অর্থ ও হিসাব বিভাগের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অডিট আপত্তির বিষয়ে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাজেটের আবেদন করলে সেখান থেকে আপত্তি নিষ্পত্তি না হলে সমপরিমাণ অর্থ কর্তন করে বাজেট আবেদন গ্রহণ করা হবে।’ অর্থনৈতিক অনিয়মে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অডিট বিভাগ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, অনিময়ের অভিযোগে যাদের ক্ষেত্রে অনিয়ম হয়েছে, তাদের পেনশনের টাকা কাটা হবে।

৪২টি অডিট আপত্তির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসাব নিয়ামক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের কোনো প্রতিবেদন আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি। এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ অডিট করার সময় আপত্তি দেওয়া হয়েছিল কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অডিট তো প্রতিবছরই হয়। খুঁজে দেখতে হবে এমন কোনো বিষয় রয়েছে কি না।

প্রসঙ্গত, ইউজিসির সর্বশেষ ৪৯তম বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে। প্রতিবেদনে দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫৩টির মধ্যে ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন অর্থবছরে মোট ১ হাজার ২৭৬ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, টাকার অঙ্কে সর্বোচ্চ অনিয়মের ক্ষেত্রে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বেশি আর্থিক অনিয়ম হয়েছে, এমন বাকি চারটি বিশ্ববিদ্যালয় হলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম হয়েছে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকার। এ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক অনিয়মসহ অডিট আপত্তি ওঠা বাকি ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অর্থবছরে মোট ১ হাজার ২৭৬ কোটি ২৫ লাখ ২২ হাজার টাকার অনিয়ম হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।