আলমগীর হোসেন ও আবদুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জীবনের ঝুঁকি ও শঙ্কা নিয়েই দিন যাপন করছে অর্ধশতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বাসিন্দারা। পরিত্যাক্ত ঘোষণার পরও অজ্ঞাত কারণে ভাঙ্গা হচ্ছে না ভবনগুলো। এসব ভবন ভাঙ্গার নির্দেশ প্রদান করা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্তদের রহস্যজনক নীরবতার কারণে এসব নির্দেশ বাস্তাবায়ন হয়নি। পরিত্যাক্ত ঘোষিত মার্কেট ও ভবনগুলোর সংস্কার ও পুনর্নিমাণ না করায় এর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন।

এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙ্গার ব্যাপারে তালিকা তৈরির পর প্রথমদিকে খুব দ্রুত বাস্তবায়নের কথা থাকলেও পেরিয়ে যায় দিনের পর বছর। ঝিমিয়ে পড়ে ভবন সংস্কার ও ভাঙ্গার কাজ। কর্তৃপক্ষের কঠোর নির্দেশের পরও এসব ভবন না ভাঙ্গার ফলে ভূমিকম্প, অগ্নিকান্ড সহ যে কোন বড় দুর্যোগে প্রাণঘাতি সহ বড় ধরনের দূর্ঘটনার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা। তদন্ত কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া হয় নানা সুপারিশ। কিন্তু সুপারিশগুলো শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে যায়, মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হয় না। ফলে রাজধানীর বহুতল ভবনগুলো হয়ে উঠছে এক একটি মৃত্যুকূপ।

এদিকে চারশ’ বছরের পুরোনো রাজধানীতে তৈরি হচ্ছে লাখ লাখ ভবন। এসব বাড়িঘর আর বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করতে বেশ ক’বার পরিবর্তন হয়েছে বিধিমালা। ১৯৫২ সালে তৈরি করা নিয়ম বদলে গেলেও শুধু বদলায়নি ঢাকা। বছরের পর বছর অগ্নিঝুঁকি নিয়েই চলছে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল-ক্লিনিক, শপিংমল, ব্যাংক, আবাসিক হোটেল ও মিডিয়া সেন্টারের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। প্রতি বছরই ঘটছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আর হচ্ছে মৃত্যু। আর এসবের জন্য রাজউকসহ সংশ্লিষ্টদের দুর্বল তদারকি ও সমন্বয়হীনতাকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা রাজধানীতে বেড়েই চলছে। এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা। কিন্তু অদৃশ্য কারণে চিহ্নিত এসব অতি ঝুঁকিপূর্ণ সরকারি ভবন অপসারণে অনীহা দেখাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শটসার্কিট কিংবা অসাবধানতাবশত যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা থাকলেও ন্যূনতম অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে। রয়েছে বহাল তবিয়তে।

অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার চিঠি ও নোটিশ পাঠানো হলেও কর্ণপাত করছেন না কেউ। মালিকপক্ষের অসচেতনতায় এসব ভবন যেন মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। জানা গেছে, রাজধানীর ৮০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে এসব অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থাহীন ভবন থেকেই।

অগ্নিনির্বাপণে এসব প্রতিষ্ঠানে এতই করুণ অবস্থা যে, যে কোনো সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অগ্নিকাণ্ড রোধে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বিদ্যুৎ বিভাগের সমন্বয় প্রয়োজন। এই চার বিভাগ এক হয়ে কাজ করলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কমে আসবে।

মুলত বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায় কারা দায়ী তা জানতে চেয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজুক) চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী। গত শনিবার আইনজীবী এম আবদুল্লাহ আল হারুন ভূঁইয়া এ চিঠি দেন। চিঠিতে জানতে চাওয়া হয়, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি

রাজধানীর বেইলি রোডে গ্রিন কেজি কটেজ ভবনে আগুন লাগার ঘটনায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে তিনি জানতে পারেন, ভবনটি যে ধরনের বাণ্যিজিকভাবে জন্য ব্যবহার হয়েছে তার অনুমোদন ছিল না এবং ভবনের সিঁড়ি নিয়ম অনুযায়ী তৈরি হয়নি। ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের কাছে বারবার ভবনের এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য নোটিশ দেওয়ার পরও কেন কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

চিঠিতে তিনি বলেন, এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল সেটির সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। ঘটনায় যাদের দায়িত্বে অবহেলা পাওয়া গেছে তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া, রাজধানীতে এরকম ঝুঁকিপূর্ণ ভবন কতগুলো রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সিলগালা করে ব্যবস্থা নিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

এই চিঠির একটি অনুলিপি গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, বন ও পরিবেশ বিষয়ক সচিব, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের সচিব বরাবর পাঠানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের উপপরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) (অ.দা.) মো. কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে কয়েক দফা রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে একাধিকবার অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করেনি। এ পর্যন্ত তাদের কয়েকবার নোটিশ ও স্মরণিকা দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানান তিনি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কখনই সুনির্দিষ্ট কোনো তালিকা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি করপোরেশনের তথ্যে রয়েছে বিস্তর অমিল। এমনটাই মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সংখ্যা জানাতে গিয়ে সরকারের এ সংস্থাগুলো আলাদা আলাদা পরিসংখ্যান জানাচ্ছে। আর তাই ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও রয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানান, ঢাকায় ৭২ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ২০০৪ সালে পুরান ঢাকায় ভবন ধসে ১৭ জনের মৃত্যুর পর অবিভক্ত সিটি করপোরেশনের করা জরিপে রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে পাঁচশর মতো ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে।

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে প্রথম ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। পরে ২০১৬ সালে তালিকাটি হালনাগাদ করা হয়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। আবার বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন রয়েছে পাঁচ হাজার। অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি ভবনের বেশিরভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। এর মধ্যে সূত্রাপুর থানা এলাকায় রয়েছে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টি। বাকি ২১টির মধ্যে মোহাম্মদপুরে ৬টি, ডেমরায় ৩টি, মিরপুরে ৭টি, রমনায় ১টি, তেজগাঁওয়ে ১টি, মতিঝিলে ২টি ও ধানমন্ডিতে ১টি।

আবার গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির ২০১৯ জানুয়ারির বৈঠকে ত্রুটিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ ভবন দ্রুত অপসারণের উদ্যোগ নিতে সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশের আলোকে ৯০৬ ভবনকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক। তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম ২৫ জুন ২০১৯ সালে পরিবেশবান্ধব আবাসিক এলাকা তৈরি করতে রাজধানী ঢাকার অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পর্যায়ক্রমে ভেঙে ফেলা হবে বলে জানিয়েছিলেন। তখন ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে ১৮১৮টি ভবন তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। শিগগিরই রাজউক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ফায়ার সার্ভিস রাজধানীর প্রায় চার লাখ ভবনের ওপর জরিপ করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পরিসংখ্যান ও অপসারণ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটিতে সাড়ে তিন হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ভবন রয়েছে। আরও এক হাজার ভবন তদন্তাধীন রয়েছে। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে সঙ্গে নিয়ে আমরা একটা প্রকল্প নিয়েছি। এটা বাস্তবায়ন করতে পারলে তা একটা মডেল হবে। তবে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে।

আমরা দ্রুতই কাজ শুরু করতে চাই। আমাদের প্রথম কাজ হবে বিল্ডিং কোড অনুযায়ী, ভবনের পাশের রাস্তাগুলো বড় করা, সেটব্যাক ভেঙে ফেলা। ঐতিহ্যবাহী ভবন রক্ষা করা, যে ভবন রাখা যাবে না, তা ভেঙে দেয়া হবে। এ লক্ষ্যে আমরা একটা প্রকল্প দাঁড় করিয়েছি। আমাদের ড্যাপের পিডিকে দিয়ে কাজ করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত কাজটি করতে পারব।’

নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, রাজউক, দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, গণপূর্ত, ফায়ার সার্ভিস এবং সিটি করপোরেশন যেভাবে ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করেছে বা করতে নেমেছে, তা আসলে কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না। এতে বছরের পর বছর লেগে যাবে। কাজটি করা দরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

যেমন: মার্কেট, শপিং কমপ্লেক্স, অফিস, বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মতো ভবন, যেখানে লোক সমাগম বেশি হয় সেগুলো নিয়ে আগে কাজ করা দরকার। সেগুলোর ফায়ার সেফটি ও সিকিউরিটি নিয়ে আগে ভাবা উচিত। আগে জরুরি ভিত্তিতে জীবন রক্ষার উদ্যোগ নিতে হবে। রাজউক যেভাবে কাজ শুরু করেছে তাতে আমার মনে হয় তারা বিষয়টি অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়।’

তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের কাজ হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে আইনের ব্যাপ্তি ঘটানো। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। প্রয়োজনে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলোতে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। তা না হলে যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ডসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ২০০৪ সালের আগে যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ছিল, তাতে বহুতল ভবনের ব্যবহার-বিধির পাশাপাশি এসব ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ও নিরোধকের ব্যবহারে কিছু ছিল না। একই সঙ্গে ভবনের বিভিন্ন পর্যায়ের নকশার পাশাপাশি ইলেকট্রিফিকেশনের কোনো নকশার বিষয়টিও ছিল না। এতে করে একটি ভবন কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে। একই সঙ্গে ওই ভবনের ব্যবহারও হচ্ছে ইচ্ছেমতো।

পুরোনো ঢাকার সরু অলিগলির দুই পাশে গেলে দেখা যাবে, এখনো গায়ে-গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ভবন। সর্বোচ্চ তিনতলা গাঁথুনি যে ভবনটির, সেখানে নির্দ্বিধায় তোলা হচ্ছে ৫-৬ তলা। জগন্নাথপাড়া এলাকায় ৩০০ থেকে ৪০০ বর্গফুট জায়গায় একটি ৫ তলা বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এর বিভিন্ন তলায় বসবাস করছেন এক পরিবারের অন্তত ১৫ সদস্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে। ১ লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আক্তার সম্প্রতি জানিয়েছেন, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সবশেষ ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসাবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে রাজধানীর ৩ হাজার ৭৮৬টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে ১ হাজার ৬৯টি প্রতিষ্ঠানকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ২ হাজার ৫৮৮টিকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং মাত্র ১২৯টি সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে এক মাসের মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করতে বলা হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানই তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করেনি।

পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিস গত ২০১৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বর এই দুই মাস আবারও ৩ হাজার ৭৩৪টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। যার ফল আবারও ১ হাজার ৬৬ প্রতিষ্ঠান খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, ২ হাজার ৫৮৩টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং মাত্র ৮৫টি সন্তোষজনক। এরপর আবারও চিঠি ও চূড়ান্ত নোটিশ দেয়া হলেও সামান্য কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার করেনি। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতেই ৮০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তালিকা অনুযায়ী, ২৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বাঙলা কলেজ, হাবিবুল্লা বাহার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠান। হাসপাতালের মধ্যে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মিটফোর্ড হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাপাতাল, ল্যাবএইড ও ইবনে সিনা।

৬২২টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ শপিং মলের মধ্যে রয়েছে: বসুন্ধরা শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, গুলশান টাওয়ার, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, পলওয়েল সুপার মার্কেট, মিরপুর শপিং কমপ্লেক্স, শ্যামলী গার্ডেন ও লালমাটিয়ার আড়ং মার্কেট। ২১টি আবাসিক হোটেলের মধ্যে রয়েছে: র‌্যাডিসন ব্লু, লা মেরিডিয়ান, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, টি ট্রি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, লা ভিঞ্জি হোটেল ও রয়েল গ্রান্ড হোটেল। ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, এনসিসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের হেড অফিস অন্যতম।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রাখে না। পরিদর্শনের পর ওইসব প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিঠি দিলেও কর্ণপাত করতে চায় না। এ ক্ষেত্রে আমরা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধও করে দিতে পারি না। এর প্রধান কারণ কর্মসংস্থানে প্রভাব পড়বে।

এ সমস্যা সমাধানে আমরা সিটি করপোরেশন ও রাজউককে নিয়ে সমন্বয় করে কাজ করছি। এরই মধ্যে অনেকে সাড়াও দিচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মাইন উদ্দিন বলেন, প্রচলিত আইন কার্যকর করতে হলে ফায়ার সার্ভিসকে অন্য কোনো সংস্থার সহায়তা নিতে হয়। মাঝে একবার ফায়ার সার্ভিস আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট চালানোর পরিকল্পনা নিলেও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পর সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসকে ক্ষমতা দেয়া জরুরি।

হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীর সুউচ্চ ভবনগুলোর ৮১ ভাগে ইকসটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র), ধোঁয়া নির্ণয়ক রয়েছে ১৭ দশমিক ১৪ ভাগে, তাপ নির্ণয়ক রয়েছে ৮ দশমিক ৫৭ ভাগে, রশ্মি নির্ণয়ক রয়েছে দশমিক ৯৫ ভাগে এবং ইন্টারকম (অভ্যন্তরীণ নিজস্ব যোগাযোগ) রয়েছে ৬০ ভাগ ভবনে। ভবনগুলোর মধ্যে ৭৯ ভাগে ইলেকট্রিসিটি সাবস্টেশন থাকলেও নিয়ম মেনে মাত্র ১৮ ভাগ ভবনে ইলেকট্রিসিটি সাব স্টেশন করা হয়েছে। জরুরি বহির্নিগমন ব্যবস্থা রয়েছে পাঁচ দশমিক ৭১ ভাগ ভবনে আর আগুন লাগলে দ্রুত বের করে আনাতে সক্ষম দুই দশমিক ৮৬ ভাগ ভবনে ফায়ার লিফট রয়েছে।

নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক রয়েছে ১১ দশমিক ৪৩ ভাগ ভবনে, জরুরি হেলিকপ্টার অবতরণ ব্যবস্থা রয়েছে ১৫ দশমিক ২৪ ভাগ ভবনে আর ৫০ হাজার গ্যালনের নিচে পানির ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ভবনের হার ৩১ দশমিক ৪৩ ভাগ। রাজধানীর মতিঝিল এবং সেগুনবাগিচা এলাকায় বহুতল ভবনের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

এদিকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে রাজউক সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিলেও তারা কোনো ভবন খালি করেছে এমন তথ্য নেই সংস্থাটির কাছে। সতর্ক করার পরও কোনো সংস্থা কাজ করছে না বিধায় রাজউক আবারও চিঠি দেয়। কিন্তু এরপরও টনক নড়ছে না প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের।

এ বিষয়ে আরবান রেজিলিয়ান্স প্রকল্পের পরিচালক আবদুল লতিফ হেলালী জানান, দু’দফা চিঠি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ভেঙে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা শুনছে না। কয়েক দিনের ভিতর তৃতীয় দফা চিঠি দিয়ে এসব ভাঙার কথা জানিয়ে দেয়া হবে। না ভাঙলে রাজউকেরই ব্যবস্থা নিতে হবে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের পর থেকে বহুতল ভবনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই যে ধরনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে বহুতল ভবনের অনুমোদন নেয়া হচ্ছে বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। শিল্প, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং মিশ্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশি ব্যতিক্রম হচ্ছে। এসব নানা অনিয়মের কারণে বিদ্যুৎ, পানি এবং অগ্নিনির্বাপকের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বাড়ছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।