মনির হোসেন ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দীর্ঘ তিন বছরের মধ্যে ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ফলে দীর্ঘদিন ধরেই বেহাল দশা পুঁজিবাজারের। মাঝে কিছুদিন ঘুরে দাঁড়ালেও ফের অব্যাহত দরপতন চলছে পুঁজিবাজারে। এতে বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব হওয়ার পথে। টানা দরপতনর হলেও বাজার ইস্যুতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ডিএসই কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছে না। যার ফলে সবকিছু মিলিয়ে পুঁজিবাজারে এখন চরম আস্থার সংকট। মুলত নিয়ন্ত্রক সংস্থার ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন, ব্যাংকের সুদের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে রয়েছে কারসাজি চক্রের দৌরাত্নে পুঁজিবাজারের এমন বেহাল দশা বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূচকের বড় দরপতন হয়েছে। এদিন ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমছে। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে মূল্যসূচক। আর বিনিয়োগকারীরা হারাচ্ছেন তাদের বিনিয়োগ করা পুঁজি। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক প্রায় তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে।

মূল্যসূচকের বড় পতনের সঙ্গে কমেছে লেনদেনের গতিও। ডিএসইতে ৫০০ কোটি টাকার কম লেনদেন হয়েছে। অন্য পুঁজিবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম কমেছে। ফলে সবকটি মূল্যসূচকের বড় পতন হয়েছে। এর মাধ্যমে টানা সাত কার্যদিবস পুঁজিবাজারে দরপতন হলো। আর শেষ ২৩ কার্যদিবসের মধ্যে ২০ কার্যদিবসেই দরপতন দেখতে হলো বিনিয়োগকারীদের।

বাজার-সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর ‘ফ্লোর প্রাইস’ প্রত্যাহারের পর বাজারে সূচক ও লেনদেন দুটোই বাড়তে থাকে। কিন্তু বাজার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ভালো কোম্পানির চেয়ে মন্দ কোম্পানির শেয়ারের দরই বেশি বেড়েছে। শুধু তাই নয়, অনেক বন্ধ কোম্পানির শেয়ার দরও কারসাজি করে বাড়ানো হয়েছে।

এসব কোম্পানির শেয়ারদর এখন কমতে শুরু করেছে। একই সময়ে দেশের শেয়ার বাজারে ভালো কোম্পানি হিসেবে পরিচিত বেশ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারদরও কমেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, বাজার নিয়ে নানা গুজব। বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়িয়ে একটি চক্র বাজারকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। যার প্রভাব পড়ছে বিনিয়োগকারীদের ওপর। গত সপ্তাহে টানা পাঁচ সপ্তাহ ধরে পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে।

২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনা সংক্রমণের পর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হলে ৬৬ দিন পুঁজিবাজারে লেনদেন বন্ধ ছিল। ২০২১ সালের শেষভাগে এসে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে এবং ডিএসইএক্স সূচকটি ৭ হাজারের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায়।

ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের শেষভাগে পুঁজিবাজার কিছুটা গতি ফিরলেও ২০২২ সালের শুরু থেকে বাজার আবার পড়তে শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডিএসইএক্স সূচক ৬ হাজার পয়েন্টের কিছুটা নিচে নেমে আসে। বাজারের পতন ঠেকাতে তখন শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস আরোপ করে বিএসইসি।

এ কারণে ২০২২ সালের জুলাই মাসের পর প্রায় ২০ মাস সূচক আর ৬ হাজার পয়েন্টের নিচে নামেনি। তবে বাজার স্থবির হয়ে পড়ে। কারণ, ফ্লোর প্রাইস আরোপের ফলে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারই লেনদেন হতো না। এ অবস্থায় ফ্লোর প্রাইস প্রত্যাহারের দাবি ওঠে। গত ২১ জানুয়ারি থেকে ধাপে ধাপে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয় বিএসইসি। এরপর একপর্যায়ে সূচকটি বেড়ে সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৪৪৭ পয়েন্টে উঠেছিল। তবে গত সোমবার সেটি কমে আবার ৫ হাজার ৮৯৮ পয়েন্টে চলে আসছে।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে পুঁজিবাজারে প্রধান সূচকের ৬ হাজার পয়েন্ট এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক সীমা হয়ে উঠেছে। তাই যখন সূচক ৬ হাজারের কাছাকাছি বা নিচে নেমে আসে, তখন বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ভর করে। এ কারণে নতুন করে কেউ বিনিয়োগ করছে না, উল্টো অনেকে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন।

একাধিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুঁজিবাজারে এরই মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ফোর্সড সেল শুরু করেছে। মার্জিন ঋণ নিয়ে যারা শেয়ার কিনেছেন তাদের শেয়ারের দাম যখন একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে যায়, তখন ঋণের টাকা উদ্ধারে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীর শেয়ার বিক্রি করে দেন। এটি পুঁজিবাজারে ফোর্সড সেল হিসেবে পরিচিত।

রফিকুল ইসলাম নামে একজন বিনিয়োগকারী বলেন, পুঁজিবাজারে অনেক দিন ধরে ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ছে না। এর বিপরীতে বাজে কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক গতিতে। তাই বিনিয়োগকারীরা অনেকটাই বাজারবিমুখ হয়ে পড়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শীর্ষস্থানীয় একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, পুঁজিবাজার যেখানে চলে গেছে, তাতে ভালো শেয়ার কিনলেই এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাই ভালো শেয়ারে বিনিয়োগের আগ্রহও হারিয়ে ফেলছি, নতুন বিনিয়োগেরও সাহস হচ্ছে না।

সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস সোমবার ডিএসইতে ৪৮৬ কোটি ৬৭ লাখ ৩৪ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। গতকাল ডিএসইতে আগের কার্যদিবসের ব্যবধানে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকার কম শেয়ার লেনদেন হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে ৫১৪ কোটি ৬৩ লাখ ৭৪ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছিল।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডিএসই’র প্রধান সূচক ‘ডিএসইএক্স’ ৬৯.৮ পয়েন্ট বা ১.১৬ শতাংশ কমে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৮৯৮.২৩ পয়েন্টে। অন্য সূচকগুলোর মধ্যে ডিএসইএস বা শরীয়াহ সূচক ১৩.৫৫ পয়েন্ট ১.০৪ শতাংশ কমে অবস্থান করছে ১ হাজার ২৮৬.২৪ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৮.৯৬ পয়েন্ট ০.৪৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪২.৬২ পয়েন্টে। গতকাল সোমবার ডিএসইতে মোট ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৪টির, কমেছে ৩৩০টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ৩২টির।

অপর পুঁজিবাজার সিএসইর প্রধান সূচক সিএসসিএক্স ৯৬.৪৮ পয়েন্ট বা ০.৯৪শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ১৬৫.৪০ পয়েন্টে। সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ১৬৫.২৪ পয়েন্ট বা ০.৯৪ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৯২৯.১২ পয়েন্টে, শরিয়াহ সূচক ৮.৩৮ পয়েন্ট বা ০.৭৫ শতাংশ কমে ১ হাজার ১০০.১২ পয়েন্টে এবং সিএসই৩০ সূচক ৯৫.৮৭ পয়েন্ট বা ০.৭৪ শতাংশ কমে ১২ হাজার ৭১৬.০৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সিএসইতে ২২৭টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৪৬টির, কমেছে ১৫৭টির ও অপরিবর্তিত রয়েছে ২৪টির। দিন শেষে সিএসইতে ১২ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। এর আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১৩ কোটি ৯৩ লাখ ৩৪ হাজার টাকার শেয়ার।