ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে সরব হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত
আলমগীর হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের পরিস্থিতি অনুকূলে থাকতে থাকতে দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি। এ জন্য গণ-অভ্যুত্থানে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ভূমিকা রাখা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সমতল মাঠ তৈরি করতে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারও চায় দলটি। এক্ষেত্রে বেশি সময় দিতে চায় না বিএনপি। ডিসেম্বরে সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার পর আগামী বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে দলটি। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, সরকারের সংস্কার কার্যক্রম দেখে তারা নির্বাচনের দাবি তুলবেন। এ জন্য সামনের দিনগুলোতে সরকারের প্রতি চাপ বাড়ানো হবে।
কারণ সরকারের তরফ থেকে ইতোমধ্যে সম্ভাব্য নির্বাচনের যে ধারণা দেয়া হয়েছে, সেটিকে ‘অস্পষ্ট ও হতাশাজনক’ বলে মনে করে বিএনপি। দলটি মনে করে, ফ্যাসিবাদীদের দেশবিরোধী নানামুখী ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় নির্বাচনই এখন সরকারের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং সেদিকেই তাদের ফোকাস করা দরকার। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠিত হয়েছে।
কিন্তু সরকারের তরফ থেকে এখনো সুনির্দিষ্টভাবে দিনক্ষণ না বলায় প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনের উদ্যোগ নিতে পারছে না ইসি। তাই নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং সরকারের ওপর রোডম্যাপের চাপ অব্যাহত রাখার অংশ হিসেবে বড় বড় সভা-সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি। গত বুধবার অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেশ কয়েকজন নেতা এমন প্রস্তাব দেন।
তবে নির্বাচনের রোডম্যাপ বা পথনকশার প্রশ্নে অন্তর্র্বতী সরকারের সঙ্গে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের একটা আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হয়নি দলগুলো। কারণ, নির্বাচন কবে হতে পারে, তা নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। বিএনপি এবং অন্যান্য দল বলছে, নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য না দেওয়ায় সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্বও তৈরি হচ্ছে।
ফলে সক্রিয় দলগুলোর বড় অভিযোগ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে অন্তর্র্বতী সরকারের নিয়মিত, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগ নেই। যখন কোনো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে, তখন প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে ডেকেছেন। এ পর্যন্ত তিন দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে সরকারের।
বিএনপি, এর মিত্র দল ও জোটগুলো এবং জামায়াতে ইসলামী প্রয়োজনীয় সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। তবে অন্তর্র্বতী সরকারের বয়স চার মাস পার হওয়ার পর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘আশা করতে পারেন যে নির্বাচন হচ্ছে ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে।’
তবে বিএনপি নেতৃত্ব মনে করে, নির্বাচনের জন্য লম্বা সময়ের প্রয়োজন নেই। তারা দ্রুত নির্বাচন চাইছে। এদিকে জামায়াতে ইসলামী সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন ২০২৫ সালের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। দেরিতে হলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্বাচনের কথা বলায় এটিকে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচক হিসেবে দেখছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে বক্তব্য স্পষ্ট নয় এবং সময় নিয়ে একটা ধারণা দেওয়ার ব্যাপারেও দলগুলোর সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে তারা। এখন দলগুলো তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে রোডম্যাপ তৈরির দাবি করছে।
সরকারের অবস্থান স্পষ্ট না হওয়ায় ইসি গঠনের পরও নির্বাচন নিয়ে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারছেন না তারা। বিএনপি এখন রাষ্ট্র মেরামতের দলীয় রূপরেখা ৩১ দফাকে নতুন করে ব্র্যান্ডিং করছে। বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার পর এখন জেলাভিত্তিক কর্মশালা চলছে, যেখানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হচ্ছেন। জেলা পর্যায়ের এই কার্যক্রম শেষ হলে নির্বাচনের দাবিতে আরো সোচ্চার হবে দলটি। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে সভা-সমাবেশের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এর দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত না হলেও আগামী ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ মাঠে নামতে পারে বিএনপি।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন এবং তার ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন ঘটে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের। বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল হিসেবে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্র্বতী সরকার। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই এই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। সরকারের প্রধান কাজ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা —এ লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলো থেকে জোরালো বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়ে জোর দাবি জানিয়ে আসছে বিএনপি ও জামায়াত।
২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তার ওই বক্তব্যে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা। রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, নির্দিষ্ট করে নির্বাচনী রোডম্যাপের ঘোষণা দিলে জনগণ আরও বেশি আশান্বিত হতো।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শুরুতে সরকারকে যৌক্তিক সময় দেওয়ার কথা বললেও এখন দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপের দাবি জানাচ্ছে। অপরদিকে, জামায়াতে ইসলামী সংস্কারে গুরুত্ব দিলেও বিলম্বিত নির্বাচন চায় না। তারা বলছে, যৌক্তিক সময়ের পরে এক মিনিটও সময় দেওয়া হবে না অন্তর্র্বতী সরকারকে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, সর্বপ্রথম প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ যে, তিনি নির্বাচনের ইচ্ছা পোষণ করেছেন। এই ধরনের সম্ভাব্য তারিখের কথা এর আগেও বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা বিভিন্ন পর্যায়ে বলেছেন। তবে নির্দিষ্ট করে যেদিন নির্বাচনী রোডম্যাপের ঘোষণা দেওয়া হবে, সেদিন জাতি আরও বেশি আশান্বিত হতে পারবে। নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা হলে যারা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাদের জন্য ভালো হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সম্ভাব্য যে তারিখ ঘোষণা করেছেন, তা একেবারে খারাপ না। তবে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শেষে একটি নির্দিষ্ট তারিখ হওয়া জরুরি। নির্বাচনী রোডম্যাপও ঘোষণা হওয়া দরকার। প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার শেষে যত দ্রুত নির্বাচন হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গলজনক। অবশিষ্ট সংস্কার নির্বাচিত সরকার করলেই তা গ্রহণযোগ্য হবে।
অপরদিকে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুষ্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আইমর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, সরকার নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছে। সুস্পষ্ট কথা এখনো বলেনি। সংস্কারকে দ্রুত এগিয়ে নিন। ক্রমান্বয়ে সুষ্পষ্ট ঘোষণাটাও দিয়ে দিন। ঘোষণাটা হলে মানুষের মধ্যে একটি আস্থা তৈরি হবে।
তিনি বলেন, যৌক্তিক সময়ের চেয়ে একটি মিনিটও বেশি নেবেন না। আমরা বলব, সংস্কারকে দ্রুত এগিয়ে নিন। ক্রমান্বয়ে সুষ্পষ্ট ঘোষণাটাও দিয়ে দিন। আজকেই দাবি করছি না, তবে ঘোষণাটা হলে মানুষের মধ্যে একটি আস্থা তৈরি হবে। এই সরকার আবার মইন ইউ সরকারের মতো নতুন দল গঠন করে ক্ষমতায় বসার অভিলাষ প্রকাশ করবে না। এ সরকারের কেউ যদি রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত্ হতে চান, তাহলে তাদের দায়িত্ব হবে এ সরকার থেকে চলে যাওয়া। তারা সরকার থেকে চলে গিয়ে দল গঠন করলে সেটি স্বচ্ছ হবে।
প্রসঙ্গত, বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সব প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি।
তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদেরকে যদি, আবার বলছি ‘যদি’, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।