স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ব্যাংকের বাইরে হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ আবার বেড়ে গেছে। গত মার্চ মাসে ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে রাখা টাকার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি। এপ্রিলে তা কিছুটা কমলেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনকে কেন্দ্র করে আগস্ট থেকেই ব্যাংকের বাইরে মানুষের হাতে ধরে রাখা টাকার পরিমাণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। অর্থাৎ এ সময় থেকে মানুষের হাতের টাকা ব্যাংকে ফিরতে শুরু করে।

ব্যাংকের আমানতের পরিমাণও বাড়তে শুরু করে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা কমে দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ২৩০ কোটি টাকায়। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। গত মার্চে মানুষের হাতে থাকা নগদ টাকার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৬ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা।

তাতে দেখা যাচ্ছে, শুধু মার্চেই ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা। সর্বশেষ এপ্রিলে মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ কিছুটা কমে হয় ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা, যা আগের মাস মার্চের তুলনায় ৬ শতাংশ কম। তবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ বেশি।

আলোচ্য সময়ে গ্রাহকরা এই পরিমাণ টাকা তুলে নিলেও সেটা আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি। ফলে এই টাকা রয়ে গেছে মানুষের হাতে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর যা আর জমা হয়নি, তা-ই ব্যাংকের বাইরে রাখা টাকা হিসেবে পরিচিত। এই টাকা মানুষ নিজের কাছে বা কোনো সমিতিতে রাখেন। এভাবে টাকা মালিকের নিজের হাতে কিংবা এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরলেও ব্যাংকে ফেরেনি।

জানা গেছে, ব্যাংক খাতে নানা অনিয়ম, ঋণ জালিয়াতিসহ নানা ধরনের খবর প্রকাশিত হওয়ায় ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা বাড়ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতি সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংকের তীব্র দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়া। এসব ব্যাংকের আমানতকারীরা আতঙ্কে টাকা তুলে নিচ্ছেন। কয়েকটি ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে না পারায় গ্রাহকের আতঙ্ক আরও বাড়ছে। এতে সুদহার বাড়ানোর পরও গ্রাহকরা নতুন আমানত ব্যাংকে রাখছেন না।

ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, মার্চে রোজার মাস থাকায় নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল। আবার মার্চে বেশ কিছু ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্তের বিষয়টিও আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এ খবরে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে আমানত তুলে নেন আমানতকারীরা। ফলে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ ছাড়া কিছু ব্যাংককে টাকা ধার দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তাতে বাজারে ছাপানো টাকার পরিমাণও বেড়ে যায়। আবার বাংলাদেশের বর্তমান

বাজারব্যবস্থায়ও নগদ অর্থের চাহিদা ব্যাপক। যেকোনো ডিজিটাল লেনদেনের ওপর করারোপ করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষ নগদ টাকায় কেনাকাটায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। গুটিকয়েক শপিংমল আর হোটেল-রেস্টুরেন্ট বাদ দিলে দেশের কোথাও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবস্থা নেই। দোকানিরাও চান লেনদেন নগদে হোক। তা ছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ হস্তান্তর করলে তার ওপর শুল্ক দিতে হয়।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রতিটি লেনদেনে শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে সাধারণ মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন এবং নগদ লেনদেন করছেন। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ী, অসৎ কর্মচারী এবং চোরাকারবারিরাও ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে আগ্রহী নয়। এ কারণেও ব্যাংকের বাইরে বাড়ছে নগদ অর্থের প্রবাহ। এর ফলে অবারিত হচ্ছে ছায়া অর্থনীতির দ্বার।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ার কারণেই ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার প্রবণতা বাড়ছে। তিনি বলেন, অনেক ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা।

এতে হয়রানিরও শিকার হতে হচ্ছে তাদের অনেককেই। এই পরিস্থিতি দূর করতে হলে ব্যাংকিং খাতে যে বর্তমান সংকট তা চিহ্নিত করতে হবে এবং সেটা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তাহলে ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। সেই সঙ্গে ব্যাংকের বাইরে টাকা রাখার প্রবণতা কমে আসবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করলেও এতদিন সেটা প্রকাশ করা হয়নি। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা প্রকাশ করায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। ফলে তারা একদিকে এসব ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। অন্যদিকে নতুন আমানতও কম রাখছেন। ফলে ব্যাংকের আমানত কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না।

ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা তুলে নেওয়ার পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে বাজারে মুদ্রা সরবরাহও বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহ কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে সেটির কার্যকারিতা কম।

নানামুখী সংকট মোকাবিলায় টাকা ছাপাতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এই টাকা ধারও দিতে হচ্ছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময় ছাপানো টাকা (রিজার্ভ মানি) ও বাজারে প্রচলিত টাকাও (কারেন্সি ইন সার্কুলেশন) বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, গত জানুয়ারিতে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, যা ফেব্রুয়ারিতে কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। অবশ্য মার্চে তা বেড়ে হয় ৪ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। একই সময়ে বাজারে প্রচলিত টাকার পরিমাণও বেড়ে যায়। জানুয়ারিতে বাজারে প্রচলিত টাকার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার ৫১০ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকায়। আর মার্চে তা বেড়ে হয় ৩ লাখ ২১ হাজার ১৬০ কোটি টাকা।