স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৯৬৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা, ঝুঁকিতে আমানতকারীরা
দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটজনক সময় পার করছে। প্রথমবারের মতো খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩০ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, যা ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ। গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতের লুকানো খেলাপি ঋণ বের হয়ে আসছে।
আবার আওয়ামী লীগ নেতা ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ এক বছরের ব্যবধানে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের এক-চতুর্থাংশের বেশি এখন খেলাপি। আর তাতেই খেলাপি ঋণে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে এখন বাংলাদেশের নাম।
মুলত ব্যাংক খাতে জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা বড় অঙ্কের সব ঋণই এখন খেলাপি হচ্ছে। এ কারণে অপরিশোধিত ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। যা ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেসব ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি বেশি হয়েছে, সেগুলোতেই বর্তমানে খেলাপি ঋণের বোঝা বেশি। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণের কারণে জালিয়াতির শিকার ব্যাংকগুলোই বর্তমানে বেশি দুর্বল। এর মধ্যে অতি দুর্বল ৫টি ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। লুটপাট করতে ১১টি ব্যাংক দখল করা হয়েছে। এরই মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি’র ঋণ খেলাপি ৫ হাজার ৯৬৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসির প্রতি আমানতকারীদের আস্থা দিন দিন কমতে শুরু করেছে, যার নেতিবাচক প্রতিফলন ঘটেছে ব্যাংকটির আমানতে।
মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটিতে গ্রাহকদের আমানত কমেছে ৬৭ শতাংশ। শুধু তাই নয়, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঋণ খেলাপিও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। মুলত ১৯৯৯ সালে বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু করা স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি ও আমানত কমে যাওয়ায় গ্রাহকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকে রাখা আমানতকারীদের টাকা যেমন আত্মসাৎ করা হয়েছে, তেমনি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচার করা টাকায় বিদেশে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিলাসবহুল প্রতিষ্ঠান। পাচারের টাকায় জালিয়াতরা এখন দেশ থেকে পালিয়ে বিদেশে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
মুলত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় দীর্ঘদিন ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ খেলাপি ও নানা অসঙ্গতির সঠিক চিত্র প্রকাশ করতে পারেনি। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাত নিয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকায় একে একে বেরিয়ে আসছে ব্যাংকগুলোর ঋণ খেলাপির আসল চিত্র। যেসব ব্যাংককে আমানতকারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ভালো বলে জানতেন, সেগুলোর ঋণ খেলাপিও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
এর ফলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক খাতের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসির ঋণ খেলাপি বাড়ায় ব্যাংকটির আমানতকারীরা পড়েছেন ঝুঁকিতে। নতুন করে ব্যাংকটিতে আমানত রাখতেও ভয় পাচ্ছেন তারা।
জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক নিজেকে মোটামুটি ভালো ব্যাংক বলে দাবি করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। যেকোনো ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ৫ শতাংশের উপরে গেলেই সেই ব্যাংক আমানতকারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে অগ্রিম আমানত হারের (এডিআর) নির্ধারিত সীমা ৮৭ শতাংশ এবং ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিনিয়োগ আমানত হার ৯২ শতাংশ। এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক আমানতকারীদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে যে ব্যাংকের ঋণ খেলাপি ৩৩৩ শতাংশ বেড়ে যায়, সেটি আর যাই হোক ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছর ২০২৪ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়েছে ২৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। এর আগের বছর যা ছিল ৭ দশমিক ১২ শতাংশ। এদিকে টাকার অঙ্কে গত বছর স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঋণ খেলাপি হয়েছে ৫ হাজার ৯৬৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর এর আগের বছর যা ছিল এক হাজার ৩৭৯ কোটি ৭১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৩৮ টাকা।
বছরের ব্যবধানে ঋণ খেলাপি বেড়েছে ৪ হাজার ৫৮৮ কোটি ৯০ লাখ ৪৩ হাজার ১৬২ টাকা বা ৩৩৩ শতাংশ। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে আস্থা হারিয়ে ফেলা গ্রাহকদের আমানত ২০২৩ সালে ছিল দুই হাজার ৬৬৫ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ৩৮১ টাকা। গত বছর তা এসে দাঁড়িয়েছে ৮৯০ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার ২৫২ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে গ্রাহকদের আমানত কমেছে এক হাজার ৭৭৫ কোটি ২৪ লাখ ৪৬ হাজার ১২৯ টাকা।
কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক অত্যন্ত তারল্য সংকটে রয়েছে। যে কারণে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের রুলস অনুসারে প্রতিষ্ঠানটি প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি পূরণ করতে পারেনি। গত বছর প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা সঞ্চিতির প্রয়োজন ছিল ৪ হাজার ১৬৯ কোটি ৭৯ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮৭ টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটি প্রভিশন রেখেছিল ৭৮২ কোটি ৯০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এক্ষেত্রে ব্যাংকটির নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি এসে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৮৬ কোটি ৮৯ লাখ ৩৩ হাজার ৯৮৭ টাকা।
জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর নিট সুদ জনিত আয় কমেছে ৮ কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার ৫৯১ টাকা। গত বছর ব্যাংকের নিট সুদজনিত আয় হয়েছিল ৩৩৭ কোটি ৫ লাখ ৩৮ হাজার ২২৭ টাকা। এর আগের বছর যা ছিল ৩৪৬ কোটি এক লাখ ৯০ হাজার ৮১৮ টাকা। ২০২৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের নিট প্রফিট হয়েছিল ১৩৬ কোটি ৭ লাখ ১৭ হাজার ৯০৭ টাকা। আর ২০২৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৮১ কোটি ২৫ লাখ ৮৩ হাজার ২৬৭ টাকা। বছরের ব্যবধানে মুনাফা কমেছে ৫৪ কোটি ৮১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪০ টাকা বা ৪০ শতাংশ।
ডিএসইর সূত্রে জানা গেছে, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ২০০৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ১১৫ কোটি ৮৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে রয়েছে ৩৩ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ২৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে দশমিক ৮ শতাংশ, সাধারন বিনিয়োগকারীদের কাছে রয়েছে ৩৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের কোম্পানির সচিব মিজানুর রহমান এফসিএস বলেন, এ বিষয় আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি পিআরডিতে যোগাযোগ করেন।



