দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে বাজারে শেয়ার বিক্রি করে তালিকাভুক্তির অপেক্ষায় থাকা কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। কোম্পানিটির কারখানা ও অফিস সরেজমিনে পরিদর্শন এবং এর আর্থিক প্রতিবেদন বিশেষ নীরিক্ষায় (Special Audit) পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে দেশের প্রথম ও বৃহত্তম এই স্টক এক্সচেঞ্জ।

ডিএসই’র ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের জন্য আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদের পরবর্তী বৈঠকে প্রস্তাবটি অনুমোদন পেতে পারে।ডিএসই সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ, একটি অতি দূর্বল মৌলের কোম্পানি কপারটেককারসাজিপূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে ভালো আর্থিক অবস্থা দেখিয়ে আইপিওতে এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর আগে কোম্পানিটি প্লেসমেন্টের মাধ্যমেও বড় অংকের টাকা সংগ্রহ করেছে।

কোম্পানিটির প্রকৃত অবস্থা যা তাতে তালিকাভুক্তির কয়েক বছরের মধ্যেই এটি রুগ্ন কোম্পানির তালিকায় নাম লেখাবে বলে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা। এতে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ বাস্তবতার আলোকে ডিএসই কোম্পানিটির বিষয়ে নানামুখী তদন্ত ও বিশেষ নিরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।

তামার তার, বার, পাইপ ও তামাজাত বিভিন্ন পণ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি কপারেটেক ইন্ডাস্ট্রিজ আইপিওর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে শেয়ার বিক্রি করে ২০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে।

আইপিও’র প্রসপেক্টাসে দেওয়া তথ্য অনুসারে,আইপিওর মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থের একটা অংশ কোম্পানিটি ভবন ও অন্যান্য পূর্তকাজের পাশাপাশি প্লান্টের যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপনের কাজে ব্যয় করবে। একটি অংশ ব্যয় করবে ব্যাংকঋণ পরিশোধ ও আইপিও প্রক্রিয়ার ব্যয় নির্বাহে।

২০১২ সালে মাত্র আড়াই কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা কপারটেক ইন্ডাস্ট্রিজ ভেল্কী দেখিয়ে মাত্র ৫ বছরের মধ্যে মূলধন ৪০ কোটি টাকা বা ১৬ গুণে উন্নীত করে। আইপিওতে আসার আগের দুই বছরে।

২০১৭ সালে কোম্পানিটি ৩ দফায় মূলধন বাড়িয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। তাতে পরিশোধিত মূলধন বেড়ে দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে কোম্পানিটি প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ৩০ কোটি টাকা সংগ্রহ করে, যা সে সময়ে বিদ্যমান মূলধনের ২ গুণ। আইপিওকে সামনে রেখেই প্লেসমেন্ট বাণিজ্যের জন্য এটি করা হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

কোম্পানির আর্থিক বিবরণীতে এমন নানা তথ্য-পরিসংখ্যান রয়েছে, যা অবিশ্বাস্য ও পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। প্রসপেক্টাসের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে অসংখ্য অসঙ্গতি পাওয়া গেছে। প্রসপেক্টাসে দেওয়া তথ্য অনুসারে, ২০১৭-১৮ হিসাববছরে কপারটেকে ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালন ব্যয় (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ সংশ্লিষ্ট ব্যয়) ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

এ হিসেবে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (MD) ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারির মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৭ হাজার টাকা মাত্র। আর এমডিসহ শীর্ষ ৬ জন কর্মকর্তার বেতন বাদ দিলে বাকী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মাসিক গড় বেতন দাঁড়ায় মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা, যা বর্তমান সময়ে একেবারেই অবিশ্বাস্য।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, হিসাব কারসাজি করতে গিয়ে কোম্পানিটি ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছে। হয় মুনাফা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য বেতন-ভাতা অস্বাভাবিকভাবে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। অথবা এটিই বেতন-ভাতার প্রকৃত ব্যয়,কোম্পানির আকার বড় করে দেখিয়ে আইপিওকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে কর্মকর্তা-কর্মচারির সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে। যেটিই করা হোক না কেন, তথ্যগুলো যে বানানো সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

কোম্পানিটির পণ্য বিক্রির তথ্যেও রয়েছে মারাত্মক অসঙ্গতি ও গোঁজামিল।আর্থিক বিবরণী অনুসারে, ২০১৮-১৯ হিসাববছরের শুরুতে আদায়যোগ্য নগদ অর্থ (Receivable) প্রায় ২ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ওই বছরে ৫২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির বিপরীতে ৫০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা পাওয়া যায়। বাকি থাকে ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অথচ আর্থিক প্রতিবেদনে আদায়যোগ্য পাওনা দেখানো হয় মাত্র ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

এমন অসংখ্য অসঙ্গতির কারণে ডিএসই মনে করছে, কপারটেকের আর্থিক প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ অস্বচ্ছ, অনির্ভরযোগ্য। এতে কোম্পানিটির প্রকৃত আর্থিকচিত্র প্রতিফলিত হয়নি। তাই আর্থিক প্রতিবেদনটির উপর বিশেষ নিরীক্ষা চালানো জরুরি।

এ বিষয়ে ডিএসইর সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক মোঃ রকিবুর রহমান বলেন, পর্ষদ সভার এজেন্ডাতে কপারটেকের বিষয়টি আছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে কোম্পানিটির আইপিওর পূর্ণ তদন্ত হওয়া দরকার।কপারটেকের আইপিও’র ইস্যু ম্যানেজার ছিল এমটিবি ক্যাপিটাল লিমিটেড।