দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: হঠাৎ করে পুঁজিবাজারে ‘ব্লক মার্কেট’ বেশ সরব হয়ে উঠেছে। গত কয়েক দিন ধরে এ মার্কেটে লেনদেন বেড়ে গেছে। তবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকরা সুবিধাভোগী ব্যবসায় ক্রমাগত জড়িয়ে পড়ছেন। নিজেদের মধ্যে শেয়ার লেনদেনের মধ্যদিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ওই শেয়ারটিতে আকৃষ্ট করছে নতুন বিনিয়োগে।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও কোম্পানির পরিচালকরা সাম্প্রতিক সময়ে অশুভ এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ছেন বলে অনেক বিনিয়োগকারী অভিযোগ করছেন। বিনিয়োগাকরীদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কারসাজির হাতিয়ার হয় উঠেছে ‘ব্লক মার্কেট’। তেমনি কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা তথ্য গোপন করেই ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেন করছেন। তাও আবার কেনা-বেনা হচ্ছে সাধারণ মার্কেটের বাজার দরের কখনো নিচে, আবার কখনো উপরে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তা পরিচালকরা অনেক সময় রাজস্ব ফাঁকি দিতে কম মূল্যে শেয়ার হস্তান্তর করছে। সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেনের পূর্বে তাদের ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও তারা তা মানছে না।

অনেক সময় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বেশি দরে শেয়ার ক্রয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্য নিজেদের মধ্যে বাজার মূল্যের অনেক বেশি দরে বড় আকারের শেয়ার হাতবদল করছেন। তবে বিনিয়োগকারীদের মাঝে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে ব্লক মার্কেটে এসব শেয়ার কারা কিনছে। কোম্পানির পরিচালকরা আইন লঙ্গন করে শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করলেও দায়সারা উত্তর দিচ্ছে।

হঠাৎ করে ব্লক মার্কেটে লেনদেন বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নিজেদের মধ্যে শেয়ারের হাতবদল করছে। জুন মাসে আর্থিক বছর শেষে প্রতিষ্ঠানের ফান্ডের আয় বা মুনাফা বাড়িয়ে দেখাতে এ কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয় জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, জুন মাসে অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর আর্থিক বছর শেষ হবে। বছর শেষে যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো আয় ও মুনাফা দেখাতে পারে, সে জন্য নিজেদের মধ্যে শেয়ারের হাতবদল করে থাকে। অতীতে দেখেছি এক মিউচুয়াল ফান্ডের শেয়ার অন্য মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে লেনদেন করা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা দুই ফান্ডের সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান থাকে একই।

একাধিক বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানির সঙ্গে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তা পরিচালকারই রাজস্ব ফাঁকি দিতে কম মূল্যে শেয়ার হস্তান্তর করছে। এছাড়াও সিকিউরিটিজ আইন অনুযায়ী, ব্লক মার্কেটে শেয়ার লেনদেনের পূর্বে ঘোষণা দেওয়ার কথা থাকলেও কোম্পানিগুলো তা মানছে না।

সাধারণত ব্লক মার্কেটে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অংশগ্রহণ করে না বরং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা ব্লকে বেশি লেনদেন করে। তবে কেউ চাইলে পাঁচ লাখ টাকার উপরের সমমানের শেয়ার ব্লক মার্কেটেকে লেনদেন করতে পারে। ব্লক মার্কেটেকে অনেক সময় কারসাজি চক্র নিজের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায় বা কাজে লাগানোর চেস্ট করে।

ব্লক মার্কেটেকে লেনদেনের আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্রেতা বিক্রেতার উভয়ের মাঝে একটা বোঝাপড়া থাকে বা অনেক সময় নাও থাকতে পারে। মূলত ব্লক মার্কেটেকে শেয়ার লেনদেন হয় ক্রেতা বিক্রেতার উভয়ের মঝে ডিল (চুক্তির) মাধ্যমে। স্বাভাবিক মার্কেটে বড় ভলিয়মের লেনদেন মূল্য হ্রাস বা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা পালন করে।

এই কারণেই স্বাভাবিক মার্কেটকে প্রভাব মুক্ত রাখতে ব্লক মার্কেটেকে লেনদেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ব্লক মার্কেটেকে শেয়ার লেনদেনের নানা উদ্দেশ্য থাকে। কয়েকটি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যাক। যেমন অনেক সময় ব্লক ট্রেড করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন ব্লক মার্কেটে কোন শেয়ারের লেনদেন একটা ভালো লক্ষণ। এখানেই ফাঁদ থাকতে পারে।

ট্রেড যে মার্কেটে হোক না কেন, যেই করুক না কেন। অভারভ্যালূড (উচ্চ দামে) দামে শেয়ার ক্রয় করা যাবে না। ব্লক ট্রেড হয়েছে মানে বড় কোন ইনভেস্টর ক্রয় করছে এ ধারণা সত্য নয়। ব্লক ট্রেডে বড় কোন ইনভেস্টর শেয়ারটি বিক্রয় করে বেরও হয়ে যেতে পারে। যে কেউ পাঁচ লাখ টাকার উপরের শেয়ার ক্রয় বিক্রয় করতে চাইলে ব্লক মার্কেটে ট্রেড করতে পারে। অনেক সময় বিনিয়োগকারীদেরকে আকৃষ্ট করতে ব্লক মার্কেটে নিজেদের মধ্যে ট্রেড করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে মোট ৩৭টি প্রতিষ্ঠান লেনদেনে অংশ নেয়। এ সময় প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ১৮২ কোটি ২ লাখ ১২ হাজার টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে। যা আগের সপ্তাহের তিনগুণের বেশি। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ৬৩ কোটি ৫৮ লাখ ৩১ হাজার টাকার শেয়ার।

ব্লকে লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে: আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, এবি ব্যাংক, সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্স, এসকে ট্রিমস, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ডরিন পাওয়ার, এস্কয়ার নিট কম্পোজিট, ইউনাইটেড পাওয়ার, মুন্নু সিরামিক, ব্র্যাক ব্যাংক, সালভো কেমিক্যাল,

শাহজিবাজার পাওয়ার, স্কয়ার ফার্মা, গ্লোবাল ইনস্যুরেন্স, জেনেক্স ইনফোসিস, আইএফআইসি ব্যাংক, মেঘনা লাইফ ইনস্যুরেন্স, রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স, স্ট্যান্ডার্ড ইনস্যুরেন্স, ফাস ফাইন্যান্স, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স, গ্রামীণফোন, ইভিন্স টেক্সটাইল, এসএস স্টিল, ইনটেক, এটলাস বাংলাদেশ, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর, বসুন্ধরা পেপার, জেএমআই সিরিঞ্জ, ইন্দো-বাংলা ফার্মা, ন্যাশনাল পলিমার, ফাইন ফুডস এবং অগ্রণী ইনস্যুরেন্স।

এর মধ্যে ব্লকে সবচেয়ে বেশি টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের। গত সপ্তাহে ব্লকে ব্যাংকটির মোট ৪১ কোটি ৪০ লাখ ১৪ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের শেয়ার লেনদেন হয়েছে ৪১ কোটি ৩৮ লাখ ২৫ হাজার টাকার। আর ১৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩৩ হাজার টাকার লেনদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এক্সিম ব্যাংক।

একই সময়ে ব্লকে এবি ব্যাংকের ১৭ কোটি ৪৮ লাখ ৭ হাজার টাকার শেয়ার, সোনারবাংলা ইনস্যুরেন্সের ১১ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকার শেয়ার, এসকে ট্রিমসের ১০ কোটি ৬৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকার শেয়ার, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১০ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার, ব্যাংক এশিয়ার ৯ কোটি ৬৫ লাখ টাকার শেয়ার,

ডরিন পাওয়ারের ৫ কোটি ১২ লাখ ২৮ হাজার টাকার শেয়ার, এস্কয়ার নিট কম্পোজিটের ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৮ হাজার টাকার শেয়ার, ইউনাইটেড পাওয়ারের ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার শেয়ার,

মুন্নু সিরামিকের ২ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার টাকার শেয়ার, ব্র্যাক ব্যাংকের ১ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকার শেয়ার এবং সালভো কেমিক্যালের ১ কোটি ৪ লাখ ২৮ হাজার টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।