দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফএসএল) বন্ধ হওয়ার পথে। এ কোম্পানির ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিপুল পরিমাণ খেলাপী ঋণ আর আমানতকারীদের টাকা ফেরতে ব্যর্থতার কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) লাইসেন্স দিয়ে থাকে। পিপলস লিজিং এর নাজুক অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকই কোম্পানিটির লাইসেন্স বাতিল ও এটিকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তার আগে তারা অর্থমন্ত্রণালয় তথা সরকারের অনুমতি নিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পিপলস লিজিং বন্ধ করে দেওয়ার অনুমতি চেয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন পাঠালে মন্ত্রণালয় তাতে সম্মতি দিয়েছে।

শুধু পিপলস লিজিং এর লিজিং ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল নয় বা ব্যবসা সাময়িক বন্ধ নয়, কোম্পানিটির পূর্ণ অবসায়ন ঘটানো হবে। তবে অর্থমন্ত্রণালয় সম্মতি দিলেও অবসায়নের জন্য হাইকোর্টের কাছ থেকে সম্মতি নিতে হবে। পিপলস লিজিং বন্ধ হলে এটিই হবে দেশে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার প্রথম ঘটনা।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পিপলস লিজিং বন্ধ খরে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সতর্ক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর্থিক খাতে যে অনিয়ম, দায়িত্বহীনতা, অদক্ষতা ইত্যাদি চলছে তার ফলে আগামী দিনে পিপলসের মতো নাজুক অবস্থায় থাকা আরও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এ বার্তাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মানের যথেষ্ট উন্নতি হবে বলে তাদের আশা।

আইন অনুযায়ী, হাইকোর্ট অনুমোদন দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অবসায়ক (Liquidator) নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই লিক্যুইডেটর কোম্পানির অবসায়ন (Wind up) এর প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তিনি কোম্পানিটির সম্পদের মূল্য ও দায়-দেনা নিরুপণ করবেন। পরবর্তীতে পাওনা আদায় ও সম্পদ বিক্রির মাধ্যমে দেনা শোধ করার ব্যবস্থা করবেন।

সুত্র মতে, চরম সংকটে থাকা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (পিএলএফএসএল) কার্যক্রম বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ জন্য ব্যাংকবহির্ভূত এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়েছে। আমানতকারীর অর্থ ফেরতসহ দায়-দেনা কীভাবে মেটানো হবে, তা আদালতের আদেশে নির্ধারিত হবে। বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের উদ্যোগ এই প্রথম। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, পিপলস লিজিংয়ে নানা অনিয়ম, বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ এবং চরম অর্থ সংকটের কারণে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারাসহ সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। চিঠিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২(৩) এবং ২৯ ধারায় প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়।

সম্মতি দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২৬ জুন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয়। চিঠি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটিতে আটকে থাকা আমানতের পরিমাণ, অনিয়মের ধরন, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ও মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে।

২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, পিপলস লিজিংয়ে মোট আমানত রয়েছে দুই হাজার ৮৬ কোটি টাকা। তবে দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনার মতো কোনো নগদ টাকা তাদের নেই। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। ১৯৯৭ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে। আর গুলশান ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা রয়েছে। পিপলস লিজিংয়ে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি দেখানো হয়েছে ৭৪৮ কোটি টাকা, যা ৬৬ দশমিক ১৪ শতাংশ।

ধারাবাহিক লোকসানের কারণে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠান ২০১৪ সালের পর থেকে কোনো লভ্যাংশ দিতে পারেনি। এর মোট শেয়ারের ৬৭ দশমিক ৮৪ শতাংশই রয়েছে সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে স্পন্সর ও পরিচালকদের হাতে রয়েছে ২৩ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ২২(৩) ধারা অনুযায়ী, আমানতকারীর স্বার্থ রক্ষায় যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই আইনের ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোম্পানি আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, হাইকোর্ট বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদনের ভিত্তিতে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নের জন্য আদেশ দিতে পারবে। একই আইনের ৮ ধারায় যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে।

আইনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন কারণে যে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারবে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছে আমাতকারীদের স্বার্থহানি হয় এমনভাবে ব্যবসা করা, দায় পরিশোধে অপর্যাপ্ত সম্পদ, অবসায়ন বা কার্যক্রম বন্ধ, লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরবরাহ ইত্যাদি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শনে উঠে আসে, পিপলস লিজিং থেকে বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক পরিচালকরা তুলে নিয়েছেন। ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ২০১৫ সালে পাঁচ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনার কথা বলে নিজ নামে জমি রেজিস্ট্রি করার মাধ্যমে আত্মসাৎ হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা।

জমি রেজিস্ট্রির এ জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ১১৬ কোটি টাকা, সাবেক পরিচালক খবির উদ্দিন মিয়া ১০৭ কোটি টাকা, আরেফিন সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন ও হুমায়রা আলামিন ২৯৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন মর্মে তখন দুদকে প্রতিবেদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বর্তমানে নয় সদস্যের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন আনান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের পক্ষে উজ্জল কুমার নন্দি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, পিপলস লিজিংসহ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এ নিয়ে প্রায়ই কোনো না কোনো আমানতকারী বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে ধরনা দিচ্ছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়, পুলিশ এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরেও অনেকে চিঠি লিখছেন। এ পরিস্থিতিতে পিপলস লিজিং অবসায়নের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য মতামত চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। সেখান থেকে সম্মতি পাওয়ার পর এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন আদালতের নির্দেশনার আলোকে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে কিছু বলা নেই। এক্ষেত্রে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, তা কার্যকর হবে। তবে সাধারণভাবে সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। আর এজন্য প্রথমে প্রতিষ্ঠানের দায় ও সম্পদ নিরূপণ করা হয়। এরপর একটি স্কিম ঘোষণা করা হয়। যেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদ উল্লেখ করে কোন পরিমাণ আমানত কবে নাগাদ পরিশোধ করা হবে তার উল্লেখ থাকে।

এর আগে অবসায়ন না হলেও ব্যাংক একীভূতকরণ, অধিগ্রহণ এবং নাম পরিবর্তন হয়েছে। ২০০৯ সালে শিল্প ব্যাংক এবং শিল্প ঋণ সংস্থা একীভূত করে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গঠন করা হয়। আর ঋণসহ বিভিন্ন পর্যায়ে অনিয়মের তথ্য ফাঁস হওয়ায় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০০৭ সালে ব্যাংকটি পুনর্গঠন করে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক নামকরণ করা হয়। মালিকানায় আসে মালয়েশিয়াভিত্তিক আইসিবি গ্রুপ।

মালিকানা পরিবর্তনের প্রধান শর্ত ছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে আমানতকারীর সব পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। এ-সংক্রান্ত স্কিম ২০০৮ সালের ৫ মে থেকে কার্যকর হয়। সে অনুযায়ী নির্ধারিত সময় শেষ হয় ২০১৩ সালের ৪ মে। তবে দফায়-দফায় সময় বাড়িয়ে ২০২১ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে অনিয়মের কারণে আলোচিত ফারমার্স ব্যাংক নাম পরিবর্তন করে পদ্মায় রূপান্তরিত হয়েছে। ব্যাংকটির মালিকানায় এসেছে সরকারি পাঁচটি ব্যাংক।