দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তেলেসমাতি কারবার অব্যাহত রয়েছে। এখানে যারা দিনরাত কারসাজি করে চলেছেন, তাদের অব্যাহতভাবে তা করার সুযোগ দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করা হচ্ছে; আর এ বিষয়ে ডিএসই, বিএসইসি বসে বসে তামাশা দেখছে। কারণ পুঁজিবাজার লুটপাটের রাঘববোয়ালদের ধরার মতো শক্তি, সাহস, যোগ্যতা, দক্ষতা, ক্ষমতা কোনো কিছুই তাদের আছে বলে মনে হয় না।

কারসাজিকারীদের ধরা, আজেবাজে কোম্পানির লিস্টিং ঠেকানো, ভুয়া অডিট রিপোর্ট দাখিল করে অতিরিক্ত প্রিমিয়ামসহ বাজার থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উপরোক্ত প্রতিষ্ঠান দুটির ভূমিকা যে একেবারেই গৌণ সে কথাটি বলাই বাহুল্য।

অন্যথায় যেসব কোম্পানি ২০-২৫ বছরে তাদের উৎপাদন যোগ্যতা হারিয়ে রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, জংধরা কলকব্জা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে, সেসব কোম্পানিকেও প্রিমিয়ামসহ বাজারে আসার সুযোগ করে দেয়া হতো না! এক্ষেত্রে এমন অনেক কোম্পানির নাম এখানে উল্লেখ করা যেত, যারা দশ টাকা অভিহিত মূল্যের সঙ্গে আরও ৭০-৮০ টাকা বা কমপক্ষে ৩০-৩৫ টাকা প্রিমিয়াম আদায় করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।

বর্তমানে পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে দু:সময়ে পার করছে। তার পর থেকে অব্যাহত দরপতন, স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা। বাজার সংশোধন, স্থিতিশীলতা আনয়ন বা বাজার বিকাশের বাধাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে কোথাও কোনো সিরিয়াস পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বন্ধু ও অভিভাবকহীন। বিএসইসি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুই স্টক এক্সচেঞ্জ, আইসিবি, বাংলাদেশ ব্যাংক, সামগ্রিকভাবে সরকার এবং বিশেষভাবে অর্থ মন্ত্রণালয় কারও যেন কোনো দায় নেই। সব দায়ভার যেন কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর।

যাঁরা তাঁদের সঞ্চিত অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে মহাপাপ করে বসেছেন। তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য শাস্তিই যেন পাচ্ছেন। তাঁরা মাঝে মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল করেন, আবার ঘরে ফিরে যান। কর্তৃপক্ষ বিরক্ত হয়। তাঁদের জুয়াড়ি, দুর্বৃত্ত ইত্যাদি গালাগালও করা হয়। আসলে পুঁজিবাজার উন্নয়নের কর্তৃপক্ষ কে বা কারা, তা এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আসলে একক কোনো কর্তৃপক্ষ থাকার কথাও নয়। অনেকের যৌথ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে ওঠার কথা।

এছাড়া ক্রেতার তুলনায় বিক্রেতা কম থাকায় এখন আর শুধু মন্দ কোম্পানির শেয়ার কমছে না। বরং বাজারের সবচেয়ে ভালো কোম্পানি যেমন স্কয়ার ফার্মা, গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো অব বাংলাদেশ (বেটবিসি) এবং রেনেটা কোম্পানির শেয়ারের দাম কমছে আশঙ্কাজনক হারে। যা পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে কম দামে শেয়ার।

তারপরও ব্যক্তি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কেনার পরিবর্তে বিক্রি করে পুঁজিবাজার ছাড়াছেন। তারা বলছেন, ‘এখন বাজারে বিনিয়োগ করলেই লোকসান’। আর তাতে বাজারে আস্থা ও তারল্য সংকট ২০১০ সালের ধসের চেয়ে বড় ধসে রূপ নিয়েছে।

একটি পক্ষ পরিকল্পতিভাবে বাজারের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংস্থাটির মতে, এই পক্ষটি নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য ‘অর্গানাইজ ওয়েতে’ (পরিকল্পিতভাবে) বাজারটাকে ধংস করার চেষ্টা করছে।

এই চক্রটি সুযোগ থাকার পর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত রেখেছে। বাজারে ক্রান্তিকালে সার্পোট দেয়ার জন্য সঠিক ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদশেকে (আইসিবি) নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। পুঁজিবাজারে টাকা বাজারে বিনিয়োগ না করে অন্যখাতে বিনিয়োগ করছে।

শুধু তাই নয়, কর সুবিধা নেয়ার পর চীনা কনসোটিয়ামের কাছে শেয়ার বিক্রির টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে না শেয়ারহোল্ডারা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নিষ্ক্রিয় রেখেছে। আর নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কমিশনের ওপর সব দায় দিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষেপিয়ে তুলছে।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, টানা পাঁচ কার্যদিবস সূচক পতন হয়েছে। তাতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন হওয়া কোম্পানির মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৪টির, কমেছে ৩১০টির, অপরিবর্তিত ছিল ১৩টি কোম্পানির শেয়ারের দাম। আর তাতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স সূচক ২৬১ পয়েন্ট কমে ৪ হাজার ১৯৭ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অন্য দুই সূচকের মধ্যে ডিএস-৩০ সূচক ৬৩ পয়েন্ট কমে ৯৪৫ পয়েন্ট এবং ডিএসইএস সূচক ৯৯ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪০৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম ও সূচক কমায় ডিএসইর বিনিয়োগকারীদের মূলধন কমেছে ১৭ হাজার ১৬১ কোটি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৭৪৮টাকা। একই অবস্থা চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই)। সেখানে বিনিয়োগকারীদের মূলধন কমেছে ১৫ হাজার ৯৪০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।

বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫৭৭ কোটি ১২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪টাকা। এর আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৩০২ কোটি ৮৯ লাখ ৪০ হাজার ৭৩১টাকা। গড় লেনদেনের পরিমাণ ১০ কোটি টাকা করে কমে ৩১৫ কোটি টাকার দাঁড়িয়েছে। এর আগের সপ্তাহে ১২৫ কোটি গড়ে লেনদেন হয়েছে।

অপর পুঁজিবাজার সিএসইতে লেনদেন হওয়া কোম্পানিরগুলোর মধ্যে দাম বেড়েছে ৩৭টির, কমেছে ২৪৭টির আর কমেছে ৮টি কোম্পানির শেয়ারের। বেশির ভাগ শেয়ারের দাম কমায় সিএসইর প্রধান সূচক ৭৭৬ পয়েন্ট কমে ১২ হাজার ৭৬৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। তাতে লেনদেন হয়েছে ৬৫ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ১৩৫ টাকা।

সার্বিক বিষয় বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক খায়রুল হোসেন বলেন, উত্থান-পতন পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু এখন পুঁজিবাজারে যা হচ্ছে তা কোনো ভাবেই কাম্য নয়। একটি গ্রুপ ‘অগানাইজড ওয়েতে’ বাজার চালাচ্ছে।

এই চক্রের কারণে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর এক্সপোজার লিমিট ২৫ শতাংশ থাকলেও, ব্যাংকগুলো বিনিয়োগ করছে না। ব্যাংকগুলোর ইচ্ছা করলেই অন্তত ১০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবে। তার কারণ পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ রয়েছে ১২-১৪ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারে ২৫-৩০ শতাংশ লেনদেনে অবদান রাখে। কিন্তু এখন ইতিবাচক কোনো অবদান রাখছে না।

সবাই বলছে বাজারে এই মুহূর্তে নতুন ফান্ড প্রয়োজন উল্লেখ করে খায়রুল হোসেন বলেন, ক্রান্তিকালে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য আইসিবিকে ১৩ হাজার কোটি টাকার ফান্ড দেয়া হয়ে। কিন্তু আইসিবি সেগুলো বিনিয়োগ করছে অন্যখাতে। আর তা দেখে বিদেশিরা বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছে। বাজারের ইন্টারমেডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কেউ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছে না। তাই বাজার ভালো হচ্ছে।

ডিএসইর তথ্য মতে, নতুন বছরের শুরুদিন স্কয়ার ফার্মা কোম্পানির শেয়ারের দাম ছিল ১৮৮ দশমিক ৭ টাকা। ৯ জানুয়ারি সেই কোম্পানির শেয়ারে লেনদেন হয়েছে ১৭০ টাকায়। একইভাবে গ্রামীণফোনে দাম ছিলো ২৮১ টাকা। সর্বশেষ দিন লেনদনে হয়েছে ২৫০ টাকায়। এছাড়াও পহেলা জানুয়ারি রেটেনার শেয়ার দাম ছিলো ১ হাজার ৯০ টাকা। ৯ জানুয়ারি সেই কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ২৬ টাকায়। এইভাবেই বিনিয়োগকারীদের পথে বসানো হচ্ছে।