এফ জাহান ও মোবারক হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে নানামুখী উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরই অংশ হিসেবে কোনও কোম্পানির শ্রেণিমানের যাতে অবনতি না ঘটে, সেই উদ্যোগও নিয়েছে বিএসইসি। এছাড়া পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে তালিকাভুক্ত তিন কোম্পানির ছয় পরিচালকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার এসব পুঁজিবাজারমুখী সিদ্ধান্তে আস্থা ফিরতে শুরু করছে বিনিয়োগকারীদের। এছাড়া নানা অনিয়মের অভিযোগে ১৬ ব্রোকারেজ হাউজকে সতর্ক করছে বিএসইসি। পাশাপাশি রিজেন্ট টেক্সটাইলের নতুন কোম্পানি ক্রয়ের বিষয় খতিয়ে দেখবে বিএসইসি। একের পর বাস্তবমুখী সিদ্ধান্তের ফলে সাধারন বিনিয়োগকারীরা বর্তমান কমিশনের প্রতি আস্থা বাড়ছে। এ কারনে নতুন নতুন বিনিয়োগকারী বাড়ছে।

এদিকে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর আবারও বাজারমুখী হতে শুরু করেছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে শেয়ারের মূল্যসূচক ও লেনদেন। গত মে মাসের ড. শিবলী রুবাইত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিটি দায়িত্ব নেয়ার পর সাত মাসে ডিএসইর সূচক বেড়েছে প্রায় এক হাজার পয়েন্ট। আর লেনদেন ২০০ কোটির নিচ থেকে এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

এ জন্য হতাশার কালো মেঘ কেটে গিয়ে দেশের পুঁজিবাজারে যেন সুবাতাস বইছে। বেরিয়ে এসেছে দরপতনের ধারা থেকে। খরা কেটেছে লেনদেনও। কিন্তু ২০১০ সালের ‘ধসের’ পর পুঁজিবাজার নিয়ে সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের কাছে নেতিবাচক ধারনাই গেছে। ফলে বাজারের প্রতি বিমুখ ছিলেন অনেক বিনিয়োগকারীই। ক্রমাগত সূচক ও লেনদেন কমতে থাকা বাজার ফের যেন ছন্দে ফিরেছে।

সূচক ও লেনদেন উঠানামা করলেও কিছুটা স্বাভাবিকতা দেখতে পাচ্ছেন স্টেক হোল্ডাররা। তারা বলছেন, এতোদিন ধরে যেসব বিনিয়োগকারী হতাশার কালো মেঘে নিমিজ্জিত ছিলেন তারাও আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। একই সাথে সরকার ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের একের পর এক সাহসী পদক্ষেপে পুঁজিবাজারে হতাশার মেঘ কেটে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। একই কারণে পতনের ধারা থেকে বের হয়েছে। কেটেছে লেনদেন খরাও।

বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত মঙ্গলবার ব্যতিত গত ৬ কার্যদিবস দুই স্টক এক্সচেঞ্জেই সূচক ও লেনদেন বেড়েছে। চলতি সপ্তাহের চতুর্থ কার্যদিবস আজ বুধবারও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের উত্থানে লেনদেন শেষ হয়েছে ।একইসাথে টাকার পরিমাণে লেনদেন বেড়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর বেড়েছে।

দিনশেষে ডিএসই এক্স বা প্রধান সূচক আগের দিনের চেয়ে ২০ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে ৫ হাজার ৬৯ পয়েন্টে। আর ডিএসই শরিয়াহ সূচক ৫ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে এক হাজার ১৬৩ পয়েন্টে। ডিএসই ৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট বেড়ে অবস্থান করছে এক হাজার ৭৬৭ পয়েন্টে। আলোচ্য সময়ে লেনদেন হওয়া ৩৫৫টি কোম্পানি ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মধ্যে দর বেড়েছে ১৪৭টির, দর কমেছে ১১৯টির এবং দর অপরিবর্তিত রয়েছে ৮৯টির।

ডিএসইতে ৮২৫ কোটি ৩১ লাখ টাকার শেয়ার লেনদেন হয়েছে। যা আগের দিন থেকে ১০৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা বেশি। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ৭১৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকার। অপরদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) সার্বিক সূচক সিএএসপিআই এদিন ৫৮ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৫৩১ পয়েন্টে। এদিন সিএসইতে হাত বদল হয়েছে ২৭১টি প্রতিষ্ঠানের। এরমধ্যে শেয়ার দর বেড়েছে ১৩২টির, কমেছে ৮৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৫১টির দর। মোট লেনদেন হয়েছে ৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার শেয়ার ও ইউনিট।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ইবিএল সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘অনেকে এই উত্থানের সমালোচনা করছে। কিন্ত আমি বলব, এটা খুবই স্বাভাবিক। রবির মতো বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে আসছে। এটা বিনিয়োগকারীদের মাঝে ইতিবাচক আকর্ষণ তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবের সুদ হার তিন/চার শতাংশে নেমে এসেছে। স্থায়ী আমানতের সুদ হার নেমেছে চার/ছয় শতাংশে। মূল্যস্ফীতি হিসাবে নিলে ব্যাংকে রাখলে কার্যত টাকা কমছে। তাই অনেকেরেই দ্বিতীয় পছন্দ এখন পুঁজিবাজার।’

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ, দূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার আন্তরিকতায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাজার। তিনি আরও বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে বর্তমান সরকার বাজেটে যে সুযোগ দিয়েছে, তা আরও ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী। সুদের হার ছয়-নয় নির্ধারণ করা, কালো টাকা সাদা করার সহজ সুবিধা যা পুঁজিবাজারের তারল্যের জন্য অত্যন্ত সহজ করে দিয়েছে, তাতে করে বাজারে টাকা ঢুকতে শুরু করেছে, যা পুঁজিবাজারে তারল্য সংকট দূর করতে বড় ধরনের সহায়তা করছে।

সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ধসের পর পুঁজিবাজারের অনেক কিছুরই উন্নতি হয়েছে। যদিও সূচক পাঁচ হাজারের ঘরেই ঘোরাফেরা করছে। তবে এ সময়ে ওয়ালটন, রবির মতো বড় কোম্পানি ছাড়াও, বেশ কিছু নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে, এটা পুঁজিবাজারের জন্য ভালো দিক। মির্জ্জা আজিজ বলেন, ‘আগের কমিশন বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে পারেনি। তবে নতুন কমিশন আস্থা ফেরাতে যেভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ করছেন তাতে আমি আশাবাদী।’