দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: গ্রাহকের সুবিধা বৃদ্ধি, ট্রেজারি চালানের অর্থ জমা দেয়ার প্রচলিত পদ্ধতি সহজ করা, ভুয়া চালান জমা ও রাজস্ব ফাঁকি ঠেকাতে এরই মধ্যে স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতি’ চালু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের যেকোনো শাখায় ট্রেজারি চালানের অর্থ জমা নেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারের ৩০ ব্যাংকও ট্রেজারি কার্যক্রমের আওতায় আসছে।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নয়টি শাখা এবং সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৪ শাখায় ট্রেজারি চালান জমা দেয়া যায়। পর্যায়ক্রমে দেশের সব ব্যাংকের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরু করতে চায় সরকার। সঠিক সময়ে চালানের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার লক্ষ্যে গৃহীত এ কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে চালানের অর্থের শূন্য দশমিক ১ শতাংশ কমিশন হিসেবে ব্যাংককে দেয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতদিন এক্ষেত্রে সোনালী ব্যাংক কমিশন পেত শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে সরকারের মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থের অধিকাংশই সরকারের কোষাগারে জমা হয় ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে। যদি মোট রাজস্বের অর্ধেকও চালানের মাধ্যমে জমা হয়, তাহলেও এক্ষেত্রে কমিশন বাবদ ব্যাংকগুলো পাবে প্রায় ১৯০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর জন্য এটি বড় আয় না হলেও ভাবমূর্তির দিকে থেকে অনেক বড় বলে মনে করছেন বাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল গত ২৫ নভেম্বর সব ব্যাংককে ট্রেজারি কার্যক্রমের আওতায় আনার বিষয়টি বাস্তবায়নে তফসিলি ব্যাংকগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকের কার্যপত্র সূত্রে জানা গেছে, ডেপুটি গভর্নর বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংক সরকারের চালানের টাকা গ্রহণ করে।

সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকার সফটওয়্যারের মাধ্যমে তফসিলি ব্যাংককে চালানের টাকা গ্রহণের অনুমতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের কোষাগারে অর্থ যথাসময়ে জমা না হওয়ায় বাজেট বাস্তবায়নে বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে সরকারকে। এতে সরকারের সুদ ব্যয় বাড়ছে। স্বয়ংক্রিয় চালান সিস্টেমের মাধ্যমে যথাসময়ে অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হবে। সরকারকে ঋণও কম নিতে হবে। তাই তিনি সব তফসিলি ব্যাংককে এ পদ্ধতি বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদানের আহ্বান জানান।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়কে দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে কোনো চালান ভুল হলে তা সংশোধন অথবা কোনো কারণে চালান বাতিল হলে করণীয় সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে লিখিত নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতিতে ট্রেজারি চালানের যে অর্থ গ্রহণ করা হবে, তা পরবর্তী কর্মদিবসে সরকারের হিসাবে জমাকরণের বিষয়টি বিবেচনার জন্যও অর্থ মন্ত্রণলায়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কমিশন দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, এ বিষয়ে প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন দিলে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে এটি চূড়ান্ত করা হবে।

ব্যাংকের কমিশনের বিষয়ে তিনি বলেন, বর্তমানে সোনালী ব্যাংক এক্ষেত্রে কমিশন পায়। আগামীতে যেসব ব্যাংক এ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে, তাদের শূন্য দশমিক ১ শতাংশ হারে কমিশন দেয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। অর্থ মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাব অনুমোদন হলে তা চূড়ান্ত হবে। গত ৮ অক্টোবর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম এবং অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার যৌথভাবে স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতি কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। সেদিন থেকেই ঢাকা কর অঞ্চল-৪-এর আওতায় ব্যক্তি ও কোম্পানি কর্তৃক প্রদেয় আয়কর জমা প্রদান শুরু হয়। অচিরেই স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতিতে’ ভ্যাট, জমি ও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ফিসহ সরকারি ১৯৬ ধরনের রাজস্ব ও ফির অর্থ জমা নেয়া হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীতে সোনালী, রূপালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের সব শাখার মাধ্যমে চালানের অর্থ দেয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢাকা মহানগরীর অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের সব শাখা এবং তৃতীয় পর্যায়ে দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় এটি বাস্তবায়ন করা হবে। স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতিতে ব্যাংকের শাখার কাউন্টারে নগদ, চেক ও অ্যাকাউন্ট ডেবিটের মাধ্যমে অর্থ জমা দেয়ার সুযোগ রয়েছে। গ্রাহকরা অনলাইন ব্যাংকিং ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমেও চালানের অর্থ জমা দিতে পারবেন।

নগদে জমা দেয়া হলে গ্রাহক তাত্ক্ষণিকভাবে চালানের কপি পেয়ে যাবেন। আর চেকের মাধ্যমে দেয়া হলে গ্রাহক চেক জমার স্লিপ পাবেন এবং পরে চেক ক্লিয়ার হলে গ্রাহককে পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী চালান দেয়া হবে। চেক গ্রহণ থেকে চালান ইস্যু প্রতিটি স্তরেই গ্রাহক তার মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাবেন।

এছাড়া অনলাইন ব্যাংকিং ও এমএফএসের মাধ্যমে অর্থ জমা দেয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরটিজিএসের (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) মাধ্যমে চালানের অর্থ তাত্ক্ষণিকভাবে সরকারি কোষাগারে জমা হবে। আর নগদ ও অ্যাকাউন্ট ডেবিটের মাধ্যমে অর্থ জমা দেয়া হলে ট্রেজারি চালানের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হবে একই দিন। চেকের ক্ষেত্রে চালানের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হবে চেক ক্লিয়ারিং হওয়ার দিন।

উল্লেখ্য, অর্থ বিভাগের বাস্তবায়নাধীন স্ট্রেনদেনিং পাবলিক ফাইন্যান্সিয়ল ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম টু এনাবল সার্ভিস ডেলিভারি’ (এসপিএফএমএস) প্রোগ্রামের অধীন ইমপ্রুভমেন্ট অব পাবলিক ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ডেলিভারি থ্রু ইমপ্লিমেন্টেশন অব বিএসএস অ্যান্ড আইবিএএস প্লাস স্কিম’-এর আওতায় উদ্ভাবিত হয় স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতি’। ট্রেজারি চালানের অর্থ জমা প্রদানে প্রচলিত পদ্ধতি সহজীকরণ, গ্রাহক ভোগান্তি হ্রাস, ভুয়া চালান জমা ও রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা রোধসহ সঠিক সময়ে চালানের অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা নিশ্চিতের জন্য স্বয়ংক্রিয় চালান পদ্ধতির উন্নয়ন করা হয়েছে।