দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: কভিড প্রাদুর্ভাবের মধ্যেও দেশের পুঁজিবাজারের সূচক বেড়েছে। বিশেষ করে কভিড সংক্রমণের সর্বোচ্চ শনাক্ত হওয়ার সময়েও বেড়েছে। সারাদেশে ৬৬ দিনের লকডাউনের পূর্বে ভালো অবস্থানে ছিল পুঁজিবাজার। কিন্তু এর যৌক্তিক কোনো কারণ দেখা যায়নি। বিশেষ করে ব্যাংক, বিমা, খাদ্য ও প্রকৌশল খাতের শেয়ারের দর বৃদ্ধি হওয়া। যদিও দেশের পুঁজিবাজারের কাঠামোগত পাঁচটি সমস্যা এখনও রয়েছে।

দেশের পুঁজিবাজার নিয়ে এমন মূল্যায়ন বের হয়ে এসেছে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচক নিয়ে করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এ গবেষণাটি করেছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কভিডের পূর্ববর্তী সময়ে দেখা গেছে পাঁচটি দুর্বলতা রয়েছে। এসব হচ্ছে দুর্বল কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করা, আর্থিক প্রতিবেদনে অস্বচ্ছতা ও অসঙ্গতি, বিও হিসাব খোলা ও সংরক্ষণে স্বচ্ছতার যথেষ্ট অভাব, সেকেন্ডারি মার্কেটে সন্দেহযুক্ত লেনদেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ বিনিয়োগ আচরণ।

‘স্টেট অব দ্য ইকোনমি ইন ফিসক্যাল ইয়ার ২০২১-২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি উল্লেখ করা হয়েছে এসব দুর্বলতা। প্রতিবেদনটি তৈরিতে সময় বিবেচনা করা হয়েছে তিন ধাপে। প্রথমত, কভিড সংক্রমণের পূর্ববর্তী সময় (২০১৯ সালের জানুয়ারি, সংক্রমণের নিকটবর্তী (আরলি ফেস অব প্যানডেমিক) ও কভিড সংক্রমণের শনাক্তের হার কমে আসার পরবর্তী সময়ের (জুন, ২০২১) সূচকের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য ব্যবহার করা হয়। ২০১৯ সালের জুন, ২০২০ সালের জুন ও ২০২১ সালের জুন মেয়াদি সময়কে বিবেচনা নেয়া হয়।

সিপিডির এই মূল্যায়নকে সময়োপযোগী হিসেবে দেখছেন এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, ‘সিপিডির পর্যালোচনা সময়োপযোগী হয়েছে। এসব দুর্বলতা আমাদের দেশের পুঁজিবাজারে রয়েছে। এগুলোর সমাধানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সক্ষমতাও রয়েছে। শুধু প্রয়োজন যথাসময়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এসব দুর্বলতা নিয়েই চলছে দেশের পুঁজিবাজার। কভিড সংক্রমণের নিকটবর্তী ও সর্বোচ্চ শনাক্তের সময়ে পুঁজিবাজারের সূচকগুলোর পতন হয়েছে। যদিও এই সময়ের মধ্যে ৬৬ দিন বন্ধ ছিল দেশের পুঁজিবাজার। কিন্তু দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পরে লেনদেন চালু হওয়ার পরই সূচকের উত্থান ঘটতে শুরু করে। সূচকের এ ঊর্ধ্বগতি চলে গত আগস্ট পর্যন্ত।

সূচকের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করে দেখানো হয়, ২০১৯ সালে সূচকের পতন হয়। ২০১৯ সালের পর থেকে আবার বাড়তে শুরু করে। ২০১২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তা বাড়তে থাকে। অপরদিকে এই সময়ে ডিএসইর মার্কেট ভ্যালুও বাড়তে থাকে সমানতালে। বিশেষ করে ২০২১ সালে পূর্ববর্তী দুই বছরের চেয়ে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে লেনদেনের হারও বেড়েছে

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বলা হয়, কভিড প্রাদুর্ভাবের হার কমে আসার পরপরই খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে পুঁজিবাজারে তার আগের অবস্থানে ফিরে গিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পূর্বের অবস্থানের চেয়েও ভালো করেছে। কভিডের পূর্ববর্তী সময়ের সূচকের উত্থানের বিষয়টি এখনও প্রশ্নবিদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। আবার কভিডের সংক্রমণের সর্বোচ্চ হারের সময়েই ডিএসইর বাজার মূলধন ও সিকিউরিটিজের দর সর্বোচ্চ বৃদ্ধি পেয়েছে। সব খাতের সিকিউরিটিজের বেলায় এটি হয়েছে। যদিও আমাদের বাজারের পাঁচটি দুর্বলতা রয়েছে।

এসবের মধ্যে ব্যাংক, বিমা এবং ওষুধ খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই ঊর্ধ্বমুখী শেয়ারদর বিবেচনায় নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে এসেছে। অবশ্য কভিড সংক্রমণ কমে আসার পরই এসব শেয়ারের দরে সংশোধন হয়। এতে করে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায় কোম্পানিগুলো।

আবার খাদ্য ও প্রকৌশল খাতের শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেয়েছে অস্বাভাবিকহারে। এজন্য খাদ্য, সেবা ও পণ্যনির্ভর প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দর বৃদ্ধি হওয়ার ঘটনায় খুবই গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।

শেয়ারের দর বৃদ্ধির এই ধারাকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে উল্লেখ করে সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, এসব বিষয় নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বিশেষ করে এই সময়ে বেশকিছু শেয়ারের অস্বাভাবিক শেয়ারদর বৃদ্ধির তথ্য গণমাধ্যমের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে।

আবার বিনিয়োগাকারীদের বিও হিসাবের ক্ষেত্রে বলা হয়, কভিড সংক্রমণের পূর্ববর্তী সময় (২০১৯ সালের জানুয়ারি) বিও হিসাবের ব্যবহার কমে গিয়েছে ২৭ দশমিক আট শতাংশ। মোট বিও হিসাবের মধ্যে গত ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০ লাখ ৩৩ হাজার পরিচালনা অর্থাৎ সক্রিয় ছিল। কভিড সংক্রমণের সর্বোচ্চ শনাক্তের সময়েও বিও হিসাবের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই সময়ে ১০ দশমিক চার শতাংশ হারে বিও হিসাবের সংখ্যা বাড়তে থাকে। মোট ৭৬ লাখ ৭২ হাজার বিও হিসাব ছিল এই সময়ে। এসবের মধ্যে মাত্র ২৬ দশমিক পাঁচ শতাংশ বিও হিসাব গড়ে সব সময়ে সচল ছিল। লেনদেন হয় না ও অস্বচ্ছতায় থাকা এসব বিও হিসাব ডরম্যান্ট করে দেয়া প্রয়োজন। যদিও এতে মোট হিসাবের এক তৃতীয়াংই অচল হয়ে যাবে।

সার্বিক বিষয়টি নিয়ে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিশেষ করে সন্দেহযুক্ত লেনদেন দ্রুত শনাক্ত হওয়া প্রয়োজন। বিএসইসি ইচ্ছে করলে এসব লেনদেন বাতিলও করতে পারে। অতিমূল্যায়িত ও অবমূল্যায়িত শেয়ারদর নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন আবু আহমেদ।

প্রবীণ এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের আচরণ অনেকটা ব্যক্তিপর্যায়ের মতো। শুধু ট্রেডিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগের দিকে যাচ্ছে না। কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদনের অস্বচ্ছতা ও অসঙ্গতি দূর করতে এফআরসি (ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল) গঠন করা হয়েছে। কিন্তু সংস্থাটিকে কার্যকর করা হচ্ছে না। পুঁজিবাজারের এসব অনিয়ম ও অসঙ্গতি দূর করতে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।’