দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানসহ তালিকাভুক্ত ৩১ ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও ৩৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই টাকা বিনিয়োগ হলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজিবাজার। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ফিরবে আস্থা। বাজার থেকে দূর হবে তারল্য সংকট।

ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারী নির্ভর দেশের পুঁজিবাজার। ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে যে লেনদেন হয়, তার মাত্র ২০ শতাংশেরও কম আসে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে, যেটি বিশ্বের বিভিন্ন পুঁজিবাজারের বিপরীত চিত্র। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) বহু বছর ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শত চেষ্টার পরও পুঁজিবাজারে এ ধরনের বিনিয়োগকারীর স্বল্পতা রয়েই গেছে।

পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বড় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী হচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংক নিজে ও সাবসিডিয়ারির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৪ ব্যাংকের মধ্যে ৩১ ব্যাংকের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বেসরকারি ৩১ ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ২২ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।
এরমধ্যে হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ রয়েছে ৮টি বেসরকারি ব্যাংকের।

ব্যাংকগুলো হলো এবি, ইস্টার্ন, আইএফআইসি, নাশনাল, পূবালী, সাউথইস্ট, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ও আল-আরাফা ইসলামী ব্যাংক। সাবসিডিয়ারিসহ পুঁজিবাজারে এসব ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা পর্যন্ত। এসব ব্যাংক তাদের রেগুলেটরি মূলধনের ২৮ থেকে ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে।

২০১৩ সালে বিনিয়োগের সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে দায়ের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রকমূলক মূলধনের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে ব্যাংকগুলো। আর সাবসিডিয়ারিসহ একটি ব্যাংক তার রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৩১ ব্যাংকের সমন্বিত মূলধনের পরিমাণ হচ্ছে ৭০ হাজার ৭৮৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
সেক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত ৩১ ব্যাংক পুঁজিবাজারে ৩৫ হাজার ৩৯২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারে।

বর্তমানে এসব ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ সীমার ৬৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে। আলোচিত সময়ে পুঁজিবাজারে এসব ব্যাংকের একক বিনিয়োগ রয়েছে ১৩ হাজার ৫৬৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। মূলত ব্যাংক ও তার সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে।

ব্যাংকের মতো প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধনের তুলনায় খুবই কম। গত সোমবার পর্যন্ত ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৬২ হাজার ৯০৭ কোটি টাকা। এ হিসেবে ব্যাংকের বিনিয়োগ মাত্র ৩ শতাংশেরও কম।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে পুঁজিবাজারে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে পূবালী ব্যাংকের।

সাবসিডিয়ারিসহ এ ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির রেগুলেটরি মূলধনের ৪০ দশমিক ৮২ শতাংশ। ১ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক, যা তার রেগুলেটরি মূলধনের ২৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ইস্টার্ন ও আইএফআইসি ব্যাংক। এ দুই ব্যাংকের বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ১৯৭ কোটি ও ১ হাজার ১৮০ কোটি টাকা।

১ হাজার ১৫৩ কোটি টাকার সমন্বিত বিনিয়োগ নিয়ে যৌথভাবে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে এবি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক। এরমধ্যে বিনিয়োগের আইনি সীমা অতিক্রম করেছে এবি ব্যাংক। ব্যাংকটি তার রেগুলেটরি মূলধনের ৫৩ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। ট্রাস্ট ব্যাংকও রেগুলেটরি মূলধনের ৫১ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ রয়েছে। মূলত বাজার মূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে বিবেচনায় বিনিয়োগের সংজ্ঞা পরিবর্তনের কারণে এ দুই ব্যাংকের আইনি সীমা অতিক্রম করে।

অবশ্য চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অতিরিক্ত বিনিয়োগ সমন্বয়ের সুযোগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আল-আরাফা ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিনিয়োগের আইনি সীমার প্রায় সমান। এছাড়া ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংকের। এ ব্যাংকটি রেগুলেটরি মূলধনের প্রায় ৪২ শতাংশ বিনিয়োগ করে ফেলেছে।

ডিএসই সূত্র জানিয়েছে, গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে যে লেনদেন হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশের বেশি হয় ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে। আর বর্তমানে তা ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, বর্তমান লেনদেনে মাত্র ১০ শতাংশের অংশীদারত্ব রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের। যদিও অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ভূমিকাই বেশি থাকে।

ভারতের পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ৫৫ শতাংশ। বিশে^র পুঁজিবাজারগুলোতে গড়ে ৪১ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে। কিন্তু নানা কারণে দেশের পুঁজিবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ অনেক কম। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীনির্ভর পুঁজিবাজারে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা দেয়। গুজব ও নানা ঘটনা দ্রুত প্রভাব ফেলে বাজারে।

এদিকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করার সক্ষমতা রয়েছে এমন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বিনিয়োগ রয়েছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের। এ ব্যাংকটি ২০৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে, যা ব্যাংকটির রেগুলেটরি মূলধনের মাত্র ৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ৭৫৯ কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির আরও ১ হাজার ২২০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। রেগুলেটরি মূলধনের মাত্র ১৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ বিনিয়োগ রয়েছে ব্র্যাক ব্যাংকের।

যমুনা ব্যাংকের রয়েছে ১৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সিটি ব্যাংকের সমন্বিত বিনিয়োগ রয়েছে ৯৯২ কোটি টাকা। এ ব্যাংকটির আরও প্রায় ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে ওয়ান, ঢাকা, এক্সিম, উত্তরা, প্রাইম, গ্লোবাল ইসলামি, সাউথবাংলা ও ইউনিয়ন ব্যাংকের বিপুল পরিমাণের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। অবশ্য নিয়মিত বিনিয়োগের বাইরে বেশ কিছু ব্যাংক বিশেষ তহবিল গঠন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে।

২০২০ সালে দেশে করোনা সংক্রমণের আগে পুঁজিবাজারে ভয়াবহ দরপতন দেখা দিলে সরকারের উদ্যোগে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় গত বছরের মে মাস পর্যন্ত দেশের ৩৭টি ব্যাংক ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠন করে, যেখান থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। অবশ্য এর প্রায় এক- তৃতীয়াংশ গেছে বেক্সিমকোর সুকুক বন্ডে।