স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপির ডাকা ২৭ জুলাইয়ের মহাসমাবেশে যোগ দিতে লাখো নেতাকর্মী ঢাকা আসতে শুরু করেছেন। পরিবহণ ধর্মঘট, পুলিশি চেকপোস্ট, ক্ষমতাসীনদের পাহারা ও পথে পথে বাধা-হয়রানির আশঙ্কায় তারা আগেভাগেই রাজধানীতে ঢুকে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিচ্ছেন। পুলিশি নজরদারি এড়িয়ে ঢাকায় ঢুকতে ৭ কৌশল বেছে নিয়েছেন নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসা বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকে ছোটখাটো, মাঝারি কিংবা বড় ব্যবসা করেন। ব্যবসার মালামাল কিনতে তারা মাঝেমধ্যে ঢাকায় আসেন। ২৭ জুলাই মহাসমাবেশ ঘোষণার পর তাদের একটি বড় অংশ ‘মাল কেনার’ এ সুযোগকে কৌশল হিসেবে নিয়েছেন। তারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প কারখানার বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য রাজধানীর ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম আদেশ দিয়ে ঢাকায় আসতে শুরু করেছেন। পথে কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করলে যাতে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন এজন্য অর্ডার দেওয়া মালের তালিকা এবং ঢাকার ব্যবসায়ীদের রেট কোড সঙ্গে রাখছেন।

আবার কেউ কেউ জেলা শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তাদের উৎপাদিত কাঁচামাল ও ব্যবসায়িক পণ্য নিয়ে ঢাকায় ঢোকার কৌশল অবলম্বন করছেন। এজন্য তারা আগেই ঢাকার ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মালের অর্ডার নিয়ে তার চালান পকেটে রেখে ঢাকামুখী হচ্ছেন।

বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকে রোগী সেজে ঢাকায় এসেছেন বলেও স্বীকার করেছেন। এজন্য তারা স্থানীয় চিকিৎসকদের রেফারেন্স ও প্রেসক্রিপশন সঙ্গে রাখছেন। এদের অনেকে বাস-ট্রেন-লঞ্চসহ বিভিন্ন গণপরিবহণ ব্যবহার করলেও সামর্থ্যবান নেতাকর্মীরা অ্যাম্বুলেন্স কিংবা নিজস্ব যানবাহন ব্যবহার করছেন। রোগীর অ্যাটেনডেন্ট পরিচয় দিয়ে সঙ্গে দলীয় ২-৩ জন কর্মী নিয়ে ঢাকায় ঢুকছেন।

মহাসমাবেশের পর নেতাকর্মীদের ঢাকায় রেখে আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণা শুনে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ঢাকামুখী হচ্ছেন। এজন্য তারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়ানোর কৌশল মাথায় নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদেরও সঙ্গে নিচ্ছেন। ঢাকার কোথায়, কোনো আত্মীয়ের বাড়ি অবস্থান করবেন তা আগেভাগে ঠিক করে রাখছেন। তাদের ঢাকায় আসার বিষয়টিও আত্মীয়-স্বজনদের আগেই জানিয়ে দিচ্ছেন। যাতে পাছে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তাদের টেলিফোন নম্বর দেওয়া হলে তারা যেন বিষয়টি জানাতে পারেন।

এদিকে ঢাকায় আসতে বিএনপি নেতাকর্মীরা অনেকে ভোল পাল্টে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী সেজেছেন। তাদের এ কৌশলের কথা অনেকে নিঃসংকোচে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, ঢাকামুখী হওয়ার আগে তারা তাদের স্মার্ট ফোন থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের মোবাইল ফোন নম্বর, তাদের সঙ্গের স্থিরচিত্র-ভিডিও সরিয়ে ফেলেছেন। এর পরিবর্তে সেখানে বেশকিছু আওয়ামী লীগ নেতার ফোন নম্বর ও তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির স্থিরচিত্র-ভিডিও আপলোড করে নিয়েছেন। অনেকের মোবাইল ফোনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা কিংবা দলের প্রথম সারির নেতার ছবি স্ক্রিন পিকচার করে ঢাকামুখী হয়েছেন।

দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী রিকশাচালক ও দিনমজুরসহ বিভিন্ন পেশার শ্রমিকের ছদ্মবেশে ঢুকে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকায় অবস্থানের কৌশল নিয়েছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রিকশার গ্যারেজে চালকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় তারা নির্বিঘ্নে সেখানে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়ি, বস্তি কিংবা মেসে থাকছেন। এদের অনেকে এরই মধ্যে ঢাকায় রিকশা-ভ্যান-ঠেলা চালানো ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজে লেগে পড়েছেন।

২৭ জুলাইয়ের মহাসমাবেশ ও পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিতে বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেকে সরাসরি ঢাকায় না ঢুকে আগামী আরও এক-দুই দিন উপকণ্ঠ এলাকায় অবস্থানের কৌশল নিয়েছেন। তারা কেউ নারায়ণগঞ্জ, কেউ গাজীপুর-টঙ্গী, কেউবা কেরানীগঞ্জ কিংবা সাভার-আশুলিয়ায় অবস্থান করছেন। যাতে ২৬ কিংবা ২৭ জুলাই প্রয়োজনে হেঁটেই ঢাকায় ঢুকতে পারেন।

ঢাকায় আসার পথে বিএনপির নেতাকর্মীরা অনেকে সামান্য টাকা সঙ্গে রেখে বিকাশ কিংবা নগদে বড় লোড নিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার এ ঝুঁকি না নিয়ে স্থানীয় আত্মীয়-স্বজন কিংবা বিকাশ এজেন্টের কাছে টাকা রেখে যাচ্ছেন। যাতে তারা ঢাকায় পৌঁছানোর পর তাদেরকে সে টাকা বিকাশ-নগদে পাঠাতে পারেন। পথে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন নেতাদের হয়রানির মুখে নগদ টাকা খোয়াতে হয় এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এবার এ কৌশল নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

ঢাকায় আসার পথে অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মী জানান, ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার মহাসমাবেশে আসার পথে চেকপোস্টে পুলিশ মোবাইল চেক করেছে। তাই এবার তারা ফোন থেকে সব ছবি, তথ্য ডিলিট করে দিয়েছেন। অনেকে আবার মোবাইলের ডিসপ্লেতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।

যশোর শহর থেকে সোমবার ভোরে ঢাকায় আসা যুবদল নেতা সাদেক হোসেন জানান, তাদের কয়েকজন কর্মীর কাছ থেকে জেনেছেন পুলিশ চেকপোস্টে মোবাইল ফোন চেক করছে। যাদের ফোনের স্ক্রিনে বিএনপির লোগো কিংবা বিএনপি নেতাদের ছবি পেয়েছে তাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছে। তাই তিনি মোবাইলের সব ছবি, তথ্য ডিলিট করে দিয়ে ঢাকামুখী বাসে উঠেছিলেন। যদিও পথে তিনি কোনো চেকপোস্টে তল্লাশির মুখে পড়েননি।

সাদেক হোসেনের সঙ্গীয় কর্মী শুক্কুর আলী বলেন, ‘আমি এর আগেও কয়েকটি জেলায় বিএনপির সমাবেশে গিয়েছি। তাই ফোনে অনেক ছবি ছিল। ঢাকায় আসার পথে সব ছবি ডিলিট করে ফেলেছি। অনেকে মাঝপথেই তাদের ছবি ও ফাইলগুলো বাসায় থাকা আত্মীয়, পরিবারের কাছে পাঠিয়ে তারপর ডিলিট করেছেন। যাতে পরে আবার সেগুলো পাওয়া যায়।’

খুলনার ডুমুরিয়া থেকে আসা ছাত্রদল কর্মী জাহিদ হাসান জানান, তারা তিন বন্ধু সোমবার সকালে ঢাকায় এসেছেন। রওনা দেওয়ার আগেই দলীয় নেতাদের কাছ থেকে মোবাইল চেকের বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন।

সেজন্য আগেই বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ দলের শীর্ষ নেতাদের ছবি ও ৭ মার্চের ভাষণের ফাইল ডাউনলোড করে রেখেছিলেন। বাসে ওঠার পর সঙ্গীয় যাত্রী ও ড্রাইভার-হেলপারদের কাছে নিজেদের আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তারা দলের শান্তি সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকায় যাচ্ছেন এ কথা জাহির করতে কৌশলে নানা গল্প শুনিয়েছেন।

সাতক্ষীরা থেকে আসা বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জানান, পথে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের তল্লাশি-হয়রানির মুখে পড়ার ভয়ে তিনি ঢাকাগামী বাসে চড়েননি। সাতক্ষীরা থেকে প্রথমে যশোর এসে সেখান থেকে লোকাল বাসে চড়ে মাগুরা পৌঁছান। পরে কয়েকটি বাস পাল্টে সাভার আসেন। সেখানে দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। মঙ্গলবার বিকালে কিংবা রাতে ঢাকায় ঢুকবেন।

বরিশাল থেকে ঢাকায় আসা শ্রমিক দলের নেতা জাহাঙ্গীর আলম, কর্মী মহাব্বত আলী, ঝন্টু শেখ ও সোহানুর রহমান জানান, তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত একজন দরিদ্র রোগীকে সহায়তা করার কথা মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঢাকায় এসেছেন। তাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে ওই চিকিৎসাকেন্দ্রের আঙ্গিনা ও বারান্দায় দিন কাটাচ্ছেন। পাছে তাদের কেউ সন্দেহ করে এই ভয়ে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না। সাইকেল পার্টস কেনার কথা বলে চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছেন যুবদল কর্মী আব্দুল হালিম। তিনি জানান, প্রতি মাসে অন্তত একবার তিনি মাল কিনতে পুরান ঢাকার বংশালে আসেন। তিনি সেখানকার আবাসিক হোটেলে থাকেন। পরে মাল কুরিয়ারে দিয়ে চুয়াডাঙ্গা ফিরেন।

সাধারণ সময় এ নিয়ে কোনো সমস্যা না হলেও গত ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশে যোগ দিতে দু’দিন আগে ঢাকায় আসার পর তিনি পুলিশি হয়রানির মুখে পড়েছিলেন। তাই এবার কোনো ঝুঁকি নিতে চাননি। ২৭ জুলাইয়ের মহাসমাবেশ এবং পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দিতে বেশ কয়েকদিন ঢাকায় থাকার টার্গেট নিয়ে এবার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় এসেছেন। ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। তারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না হলেও বিএনপির সমর্থক। তাই কয়েকদিন তিনি বাসায় অবস্থান করলে কোনো অসুবিধা হবে না বলে মনে করেন আব্দুল হালিম।

গাজীপুর-টঙ্গী, আশুলিয়া-সাভার, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার উপকণ্ঠ এলাকার যায়যায়দিনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী নানা কৌশলে সেখানে অবস্থান করছেন। এদের একটি বড় অংশ নানা কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এ কারণে স্বাভাবিকভাবে তাদের শনাক্ত করা কঠিন।

এদিকে ঢাকার ২৭ জুলাইয়ের মহাসমাবেশকে সামনে রেখে হার্ডলাইনে প্রশাসন। এ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে চালানো চলমান তল্লাশি অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। আবাসিক হোটেল, মেস ও বস্তিগুলোতে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে যে কোনো কর্মসূচি পালন করলে পুলিশ তাতে বাধা দিবে না। এমনকি তাদের নেতাকর্মীদের ঢাকায় আসার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরির টার্গেট তাদের নেই। তবে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মিশন নিয়ে কেউ ঢাকায় জড়ো হচ্ছে কিনা তা তারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তাণ্ডব সৃষ্টির পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।

সমাবেশ ঘিরে কোনো ধরনের নাশকতার চেষ্টা করা হলে ছাড় দেওয়া হবে না বলে আগাম হুঁশিয়ার করেছেন মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি বলেন, ২৭ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ হলে অনুষ্ঠানস্থল ও এর আশপাশের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং যে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে সেখানে অনেক পুলিশ সদস্য কাজ করবেন। অসাধুচক্র কোনো ধরনের সমস্যা যেন না করতে পারে সেজন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কেউ বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করছে কিনা সে বিষয়েও আগাম তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

ডিবিপ্রধান বলেন, কোনো রাজনৈতিক দল কর্মসূচি পালন করলে সেই কর্মসূচি যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হয়, তা নিশ্চিত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। আমরা সেভাবেই বিএনপির মহাসমাবেশ সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছি। তারপরও কেউ যদি নাশকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায় আমরা তাকে ছাড় দেবো না। তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সূত্র: যায়যায়দিন