মনির হোসেন, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহলের নানা তৎপরতার সময় বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে ভারত। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় অতীতের মতোই বাংলাদেশের পাশে থাকবে বন্ধুরাষ্ট্রটি। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নিকটতম প্রতিবেশীর ইতিবাচক অবস্থানে আওয়ামী লীগের পালে বইছে সুবাতাস। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ভারত সফর এবং প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরের উজ্জীবিত আ’লীগের নেতাকর্মীরা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজপথের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর নানান তৎপরতায় বাহ্যত মনে হচ্ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হয়তো কিছুটা চাপেই রয়েছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে দৃশ্যপটে যেন অনেকটাই পরিবর্তন ঘটে গেছে। ভারতে জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদান এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ঢাকা সফর নিয়ে নানা আলোচনা সরকারী বেসরকারী সহ সব মহলে।

অনেকে শেখ হাসিনার এ বিচক্ষণতাকে নির্বাচনের আগে সফল কূটনীতি হিসেবে দেখছেন। কারও কারও ভিন্নমত রয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা অফিসে কাজের মধ্যেই গল্পের ছলে করছেন এসব আলোচনা। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের সেলফির বিষয়টি। কারণ, জো বাইডেন নিজের ফোনের ক্যামেরায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর কন্যার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্টের সেলফি তোলার এ দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ ছবিটি দেশে বিদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে। বিশ্বের প্রভাবশালী একাধিক গণমাধ্যমেও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ, নানা ধরনের স্যাংশন আসবে দেশের ওপর- এসব নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিল তখন দুই দেশের সরকার প্রধানের এমন ছবি আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

তাছাড়া জি-২০ সম্মেলন উপলক্ষে ভারত সফরকালে বিশ্বনেতাদের কাতারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরব ও প্রাণবন্ত উপস্থিতি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই সফরের পর থেকে দৃশ্যত আরও বেশি উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের অব্যবহিত পূর্বে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং পরপরই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ঢাকা সফরের মধ্য দিয়েও বর্তমান সরকারের প্রতি তাদের বিশেষ সমর্থন ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন দলটি বেশিরভাগ নেতা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহলের তৎপরতায় মনে হচ্ছিল সরকারের ওপর ক্রমশ চাপ তৈরি হচ্ছে। সেটা মনে করার মতো যথেষ্ট কারণও ছিল। কেননা পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিক ও দাতা সংস্থার প্রতিনিধিরা ধারাবাহিকভাবে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে যাচ্ছিলেন।

প্রতিটি বৈঠকের পর তাদের দেওয়া ব্রিফিংয়ের মধ্য দিয়ে নির্বাচন ঘিরে নানা ধরনের কথাবার্তা প্রকাশ পেতে থাকে, যা থেকে এক ধরনের সংশয়াচ্ছন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে দেখা যায়। ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন’ নিশ্চিত করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর বিদেশিদের সেই চাপ অব্যাহতই রয়েছে।

এই গুমোট পরিস্থিতিতে নতুন মোড় নিয়ে আসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জি-২০ সম্মেলনে অংশগ্রহণ। সেখানে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বিশেষ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ সবকিছুই ছিল দারুণ ইতিবাচক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরের সফল সমাপ্তির পর বেশ উজ্জীবিত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে তার প্রকাশ পাওয়া যাচ্ছে।

রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা মনে করেন, দেশি-বিদেশি সব পক্ষের তৎপরতায় গত দুই নির্বাচনের চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ বেশ প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছিল সার্বিক বিবেচনায়। কূটনৈতিক তৎপরতার প্রতিফলন বিএনপির আন্দোলনেও দেখা যাচ্ছিল। তারা রাজধানীসহ সারা দেশের কর্মসূচিগুলোতে বড় বড় জমায়েত ঘটিয়ে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করতে সক্ষম হবে এমনটাও মনে করতে শুরু করেছিল অনেকেই। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। তবে মাত্র দুই দিনের একটি সফর রাজনীতির দৃশ্যপটে ছাপ ফেলতে শুরু করেছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের মতে, দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিদই নন, দক্ষ কূটনীতিকও। জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সেটাই প্রমাণ করেছেন তিনি। তার অবিচল দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে বিএনপি ‘বিদেশি চাপের’ যে জুজুর ভয় দেখাতে শুরু করেছিল তাতে পানি ঢেলে দিয়েছে জি-২০ সম্মেলন।

ভিসানীতিসহ বিভিন্ন ধরনের ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না, সেটা অনেকেই বুঝতে পেরেছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ তথা আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত বন্ধুত্ব নিয়ে যারা নানা অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল, সেটারও উচিত জবাব দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে যে দেশটি সবচেয়ে বেশি তৎপর সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলে যেন অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলিয়ে দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর গৌরবোজ্জ্বল উপস্থিতি দেশের আপামর জনগণকে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত ও গর্বিত করেছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের তোলা সেলফি নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছ থেকে জাতি প্রত্যাশা করে না। এক সেলফিতেই বিএনপির নেতাদের রাতের ঘুম হারাম।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত জি-২০ সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতি বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। সুদক্ষ নেতৃত্ব, অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এবং কর্মকুশলতার উজ্জ্বল প্রভায় বিশ্বনেতাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছেন শেখ হাসিনা।

ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের তোলা সেলফি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবে এমনটা তিনি মনে করেন না। তবে এটা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে।

কূটনৈতিক অঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আওয়ামী লীগের একটি সূত্র জানায়, শুধু জি-২০ সম্মেলন নয়, এর আগের ও পরের ঘটনাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফ্রান্সের একটা আধিপত্য রয়েছে। এমন একটি দেশের প্রেসিডেন্ট যখন শেখ হাসিনার সরকারের প্রশংসা করে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ দেখান, তখন আর আলাদা করে কিছু বোঝার বাকি থাকে না। এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তার সফরও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে একটি বড় বার্তা।

এই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। আমরা যেটা চেয়েছিলাম প্রধানমন্ত্রী তার দক্ষতা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, বিএনপি জনগণের চোখে ধুলা দিতে নানা চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বাইরের দেশের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্পর্ক ও সৌহার্দ্য দেখে অনেকেরই সহ্য হচ্ছে না। বিএনপির উচিত হবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।