দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: রুহ আফজা। সুস্বাদু শরবত। উপমহাদেশ তথা ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশে রয়েছে যার ব্যাপক পরিচিতি। দীর্ঘ বছরের জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হামদার্দ ল্যাবরেটরি (ওয়াকফ) বাংলাদেশ। কিন্তু সুনামের পেছনে রয়েছে খানিকটা অন্ধকারগলির ছোঁয়া। মানবদেহের জন্য অনেক গুণে ভরা প্রচারণায় ঘটেছে ছন্দপতন। বলা হয়েছে প্রায় সব ধরনের গুণ আছে রুহ আফজায়। বিভ্রান্তিকর এ তথ্যের মাধ্যমে প্রতারণা করা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে।

সহজ-সরল মানুষকে বোকা বানিয়ে বছরের পর বছর হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। রমজান এলেই ধুম চলে ইফতারের সঙ্গে একটু ঠান্ডা শরবতের আয়োজন। বাক্য বিনিময়হীন যে নামটি আসবে তা হলো রুহ আফজা। রুহ আফজা শরবত ও ফ্রুট সিরাপ। স্বাস্থ্যকর ফলের খাদ্য পণ্য। বোতলের গায়ে লাগানো লেবেলে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন প্রচারে প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে রয়েছে এমন ফুলঝুড়ি। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ওয়েবসাইট ও ইউটিউবের মাধ্যমে মিথ্যা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে কোটি কোটি মানুষের সঙ্গে হামদর্দ প্রতারণা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। রুহ আফজা প্রতারণার মাধ্যমে বাজার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।

জানা গেছে, ৩৬ ধরনের টাটকা ফলের সুস্বাদু রস, মূল্যবান ঔষধি উদ্ভিদ ও তাজা ফুলের নির্যাস দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যকর হালাল পানীয় রুহ আফজা। এটি খেলে ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়। প্রাণভরে এই অমৃত সুধা পান করলে পূরণ হয় শরীরের পানির ঘাটতি। মুখরোচক এমন তথ্যসহ বিজ্ঞাপন দিয়ে পবিত্র রমজান মাসে বিক্রির শীর্ষে থাকে ‘রুহ আফজা’ নামের শরবত। যুগ যুগ ধরে এটি উৎপাদন ও বাজারজাত করছে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ। তবে পণ্যের লেবেল এবং বিজ্ঞাপনে সেসব উপাদানের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে রুহ আফজায় এখন আর এসবের কিছুই নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) উদ্যোগে বাজার থেকে সংগৃহীত রুহ আফজা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। পণ্যের মিথ্যা প্রচারণার বিষয়টি স্বীকার করে লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়েছেন হামদর্দের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। আবার বিষয়টি নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি না করতে হামদর্দের পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তাকে ঘুষের প্রস্তাবও দেওয়া হয়। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) এবং খাদ্য অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছে সিটি করপোরেশন।

জানা যায়, শত বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে জনপ্রিয় পানীয় হিসেবে পরিচিত রুহ আফজা। ১৯০৬ সালে ইউনানি চিকিৎসক হাকিম হাফিজ আব্দুল মজিদ পুরোনো দিল্লিতে তার চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। ১৯০৭ সালে নিজস্ব উদ্ভাবনে বাজারে আনেন রুহ আফজা। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি মানুষের আস্থা অর্জন করে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তার বড় ছেলে ভারতে থেকে গেলেও ছোট ছেলে পাকিস্তান চলে যান। করাচিতে স্বতন্ত্র হামদর্দ (ওয়াকফ) ল্যাবরেটরিজ চালু করেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানেও এর শাখা স্থাপিত হয়।

স্বাধীনতার পর হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ নাম দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। বর্তমানে এটি একটি ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। হামদর্দের অনেক পণ্যের মধ্যে রুহ আফজা ভোক্তাদের চাহিদার শীর্ষে। বিশেষ করে রোজার মাসে এই শরবতের বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়।

প্রতারণার ফাঁদ হিসেবে দেখা যায়, হামদর্দের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ৩৬ প্রকার ফলমূল দিয়ে তৈরি, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্বাস্থ্যকর পানীয় খাবার, সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে, শরীরে পানির ঘাটতি দূর করে, সুস্বাদু টাটকা ফলের রস ও মূল্যবান ঔষধী উদ্ভিদ তাজা ফুলের নির্যাস, অমৃত সুধা ইত্যাদি। বিশ্বে রুহ আফজার উপরে কেউ আসতে পারেনি। এমন অনেক কথাই আছে তাদের বিজ্ঞাপনে।

যার বেশিরভাগই মিথ্যা ও প্রতারণার শামিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে, রুহ আফজা শরবতে রয়েছে ৪ রকমের ফুল, ১০ রকমের ফল এবং ১২ রকমের ভেষজ উপাদান। আর ইনভার্ট সুগার রয়েছে ২৭ প্রকার। প্রাকৃতিক সতেজ পানীয় বলে প্রচার করা হলে, অন্য দিকে তারা বলছে বিভিন্ন প্রকার ফল, গোলাপ ফুল, হার্বসের নির্যাস থেকে অনুমোদিত ফুড কালার দিয়ে তৈরি রুহ আফজা।

আরো বলা হয়েছে, সুস্বাদু সুষম, নয়ন জুড়ানো রং ও গুণাবলীতে পৃথিবীতে আরেকটিও নেই ১১১ বছরের ঐতিহ্যবাহী শরবত রুহ আফজা। আবার যেমন: মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, লিভার, কিডনী ও ফুসফুসকে শক্তিশালী করে, শরীরে স্বাভাবিক শক্তি পুনরুদ্ধার করে, হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ করে ইত্যাদি বানোয়াট বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে হামদার্দ ল্যাবরেটরিজ (ওয়াকফ) বাংলাদেশ। এভাবে নানা মিথ্যচার ছড়াচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

একই সঙ্গে ভিটামিন এ, বি-১, বি-৬, সি, ডি ইত্যাদি ভিটামিন রয়েছে বলে বিজ্ঞাপন ও লেবেলে উল্লেখ করেছে হামদর্দ। প্রশ্ন হলো একটি মাত্র প্রডাক্টে কি করে এতো উপাদান থাকে। রুহ আফজার বিক্রয় কৌশলে যে স্লোগান দিচ্ছে, তার সঙ্গে আসল খাদ্য পণ্যের কোনো প্রকার সম্পর্ক নেই। বরং রয়েছে স্পষ্টতই জনগণকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ধোকা দিয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় প্রচার করে আসছে। তাদের পণ্যের লেভেলে লেখা রয়েছে ফ্রুট সিরাপ খাদ্য পণ্য স্বাস্থ্যকর ফলের শরবত।

ফুড সেফটি অফিসার ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক কামরুল হাসানের করা মামলার নথি থেকে বেরিয়ে এসেছে, মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে মানুষ ঠোকানোর চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক মো. কামরুল হাসান সম্প্রতি বাজার থেকে রুহ আফজা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করান। ফলাফলে রুহ আফজা বিক্রির প্রচারণায় ব্যবহৃত নানা তথ্যের সঙ্গে গরমিল প্রকৃত উপাদানের গরমিল পাওয়া যায়। পণ্যের প্রচারে স্বাস্থ্যকর ফলের শরবতসহ প্রাকৃতিক নানা উপাদানের কথা বলা হলেও বাস্তবে এর কোনোটাই নেই। প্রতারণার এমন প্রমাণ পেয়ে ২০১৮ সালে মামলা করেন সিটি করপোরেশনের খাদ্য পরিদর্শক।

মামলার আসামি হামদর্দের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার করে লিখিত দেন। জরিমানা হিসেবে হামদর্দ চার লাখ টাকাও পরিশোধ করে। যদিও এরপর হামদর্দের পক্ষ থেকে আপিল করা হয় এবং আদালত জরিমানার টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশনা দেয়। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এ বিষয়টি জানার পর এর বিরুদ্ধে আপিল করার জন্য গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বরাবর চিঠি দেন। এর পরই সেই আপিল ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে হামদর্দ কর্তৃপক্ষ। এমনকি কোম্পানিটির পক্ষ থেকে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ঘুষের প্রস্তাবও দিয়েছেন।

এ বিষয়ে কামরুল হাসান বলেন, ‘মিথ্যা তথ্য দিয়ে রুহ আফজা বিক্রি করছে হামদর্দ। বিষয়টি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আমি যাতে আপিল না করি, সেজন্য হামদর্দের কর্মকর্তারা বেশ কয়েকবার ঘুষের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে ঘুষের প্রস্তাব দেওয়ার সময় ভিডিও করে রেখেছি। এছাড়া শুধু ঘুষ অফার নয়, হামদর্দ শুরু থেকেই অনৈতিক কাজ করছে। একটি আদালতে নিজেদের দোষ স্বেচ্ছায় স্বীকার করে নেওয়ার পর আরেক আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করাটাই অনৈতিক।’