দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মতো বিএনপি ইতোমধ্যে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে দলটি শুধু নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, কর্মসূচি নিয়েও মাঠে নামবে। এ ক্ষেত্রে বিগত জাতীয় নির্বাচনের মতো একই কৌশল অবলম্বন করবে বিএনপি। নিজেরা দলগতভাবে ভোট বর্জনের পাশাপাশি জনগণকেও ভোট বর্জনের আহ্বান জানাবে। আর ভোট বর্জনের এ আহ্বানকে একটি ক্যাম্পেইনে রূপ দিতে চায় তারা। বিএনপি পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার সাজানো নির্বাচন কমিশনের অধীনে এবং প্রশাসন ও পুলিশের প্রকাশ্য একপেশে ভূমিকার জন্য এর আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি।

এখনো সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হয়নি। নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলের যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে দলটি। দলটির ধারণা, উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় নির্বাচনের বৈধতা দেয়া ও নির্বাচন কমিশনকে মেনে নেয়া। এ কারণে তৃণমূলের চাপকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন বর্জনের সীদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রমতে, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি গত সোমবার রাতে বৈঠক করে বর্তমান সরকারের অধীনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বর্জনের ধারাবাহিকতায় উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত মঙ্গলবার গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়।

তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচনি প্রহসনের অংশীদার হতে চায় না বিএনপি। সে কারণে ৮ মে থেকে শুরু হওয়া উপজেলা পরিষদের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুলত প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অন্তত ৪৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। ইতোমধ্যে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন তাদের প্রত্যাহার করতে হবে বলে দলের তৃণমূলকে বার্তা দিয়েছে বিএনপি। অবশ্য মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হবে ২২ এপ্রিল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি। তাই এখন উপজেলা নির্বাচনে গেলে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। প্রশ্ন তোলা হবে কেন জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হয়নি। এছাড়া মাঠের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে যদি প্রভাবশালী ও সম্পদশালী কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয় তাহলে দলে আবার ভাঙন বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির যে অভিযোগ রয়েছে— সরকার গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ব্যর্থ; নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন দলীয় সরকারের অনুগত এগুলো নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হবে।

জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের পরামর্শ নিয়েছে বিএনপি। নেতাদের কেউ কেউ দলগতভাবে নির্বাচন বর্জন করলেও যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চান তাদের বিষয়ে নমনীয় থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে পথে হাঁটেননি দলের নীতিনির্ধারকরা। তৃণমূলের মতামত ও সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আদলে উপজেলা নির্বাচন করবে সরকার। এ জন্য দলীয় নেতাদের প্রতীক দেয়নি আওয়ামী লীগ। উন্মুক্ত মাঠে আওয়ামী লীগ নেতারা সবাই স্বতন্ত্র প্রার্থী। মূলত দেশ-বিদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে এ আয়োজন করা হলেও নিয়ন্ত্রণ থাকবে সরকারের হাতে। সরকার যাকে ইচ্ছা তাকে নির্বাচিত করে আসবে। এ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে তাতে ভোটের প্রক্রিয়াকে বৈধতা দেয়া হবে। মাত্র তিন মাস আগে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি।

সেই নির্বাচনে বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যায়নি। সাধারণ মানুষের সেই সমর্থনে আঘাত দিতে চায় না বিএনপি। জনগণের মাঝে বিএনপির নৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখতে বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার ফলে নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে যাবে না। এর ফলে দেশ-বিদেশে আবার বার্তা যাবে, বিএনপি ছাড়া নির্বাচন ও গণতন্ত্র অর্থহীন।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হবে আওয়ামী লীগ। ফলে মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক সংঘর্ষ হতে পারে। আওয়ামী লীগের সেই সংঘর্ষের বিএনপি কোনো প্রতিপক্ষ হতে চায় না। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ও যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য অটুট রাখার বিষয়টিও বিবেচনায় নিয়েছে বিএনপি।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনীহার কারণেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাচ্ছে না দলটি। উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নাকরার বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, দলের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ২৬৮ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন তারেক রহমান। উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে অধিকাংশ নেতাই মতামত দেন। কার্যত সে মতামতের ওপর ভিত্তি করে স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত হয়।

ইসি সূত্রে জানা যায়, এবার চার ধাপে ৪৮০টি উপজেলা পরিষদে ভোট হচ্ছে। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫০টি উপজেলায় ভোট। দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২১ মে ১৬৬টি উপজেলায়। গতকাল ১৭ এপ্রিল ১১২টি উপজেলায় তৃতীয় ধাপের তফসিল ঘোষণা করা হলো। চতুর্থ ধাপের তফসিল এখনো ঘোষণা হয়নি ।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এ কমিশন আওয়ামী লীগের অনুগত। বর্তমানে পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাই সরকারের অনুগত। ক্ষমতাসীন সরকার কখনোই জনগণের ভোটে বিশ্বাসী নয়, নির্বাচিতও নয়। জাতীয় নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। ৫ শতাংশ ভোটার জাতীয় নির্বাচনে কেন্দ্রে যায়নি। যে সরকারের জনগণের আস্থায় নেই সেখানে আমাদের অংশগ্রহণ চিন্তাও করা যায় না। আপনারা দেখেন বিএনপিসহ অনেকেই ভোট বর্জন করেছে এর মধ্যেই ক্ষমতাসীন দল নিজেরা কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের নিজেদের যেখানে নিরাপত্তা নাই সেখানে আমাদের কে নিরাপত্তা দেবে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর পরও যারা মনোনয়োন দাখিল করেছেন তাদের দলের পক্ষ থেকে মনোনয়োন প্রত্যাহার করার জন্য বলা হয়েছে। এখনো যেহেতু মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় রয়েছে সেহেতু আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করছি। তার পরও যদি কেউ মনোনয়োন প্রত্যাহার না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আগের মতোই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, এ দেশের নির্বাচনে আর বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সব চর দখলের মতো হয়ে গেছে। দেশের জনগণের মধ্যে ভোট নিয়ে গণহতাশা গণঅনাস্থা কাজ করছে। এখন নির্বাচনে যেহেতু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই তাই আওয়ামী লীগ এখন নিজেদের মধ্যে অঞ্চল দখলের প্রতিযোগিতায় রয়েছে। নিজেরা নিজেদের ঘরে দখল নিয়ে মারামারি করছে।