আ’লীগ নেতাদের পালানোর রুট বৃহত্তর সিলেট সীমান্ত
সিলেট ব্যুরো, দেশ প্রতিক্ষণ: নতুন করে আলোচনায় সিলেটের সীমান্ত এলাকা। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বাঘা বাঘা নেতারা সিলেট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছেড়েছেন বলে নানান গণমাধ্যম দাবি করছে। চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া সিলেটের সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ নেতারা পালাতে গিয়ে ধরা পড়ছেন। অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না। সীমান্তের জঙ্গলে কলাপাতায় শুয়ে থাকা অবস্থায় আটক হয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।
তবে এমপি-মন্ত্রীর পলায়নের চেয়েও বড় খবর হয়ে এসেছে ১ সেপ্টেম্বর রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে ১৩ বছরের কিশোরী স্বর্ণা দাশ নিহতের ঘটনা। এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এ ধরনের জঘন্য কাজের পুনরাবৃত্তি রোধ এবং সব সীমান্ত হত্যার তদন্ত পরিচালনা ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। অন্যদিকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে অনুরোধ করেছে বিএসএফ। সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবিও।
সিলেট বিভাগের চার জেলাকেই সীমান্ত ভাগ করতে হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে বৈধভাবে বাণিজ্যিক ও জনযোগাযোগ রক্ষা করা হয় তামাবিল, শেওলা, ভোলাগঞ্জ ও বাল্লা স্থল বন্দরের সঙ্গে প্রায় ১৩টি শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে। তবে এর বাইরেও মানবপাচার ও চোরাচালানের জন্য বারবার আলোচনায় আসে সিলেট সীমান্ত।
এই চোরাচালানে মাদক, চিনি, গবাদিপশুর সঙ্গে থাকে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের চালান। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি প্রায় নিয়মিতই এসব চালানের কিছু অংশ জব্দ করে। তবে অসাধু প্রশাসনের কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাবে শতকোটি টাকার চোরাই চালান পার পেয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে।
সিলেটের পাহাড়, হাওর ও নদীবেষ্টিত সীমান্ত এলাকায় বৈধ ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই দুই দেশের সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে সীমান্ত অতিক্রম করার প্রবণতা আছে।
ভৌগোলিক কারণে আত্মীয়তাও আছে দুই দেশের সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে। আবার চোরাকারবারের জন্য সীমান্তে গড়ে ওঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই চক্রটি প্রশাসনের অসাধু অংশের সহযোগিতা নিয়ে চোরাকারবারের সঙ্গে মানবপাচারের কাজটিও করে থাকে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের এই চক্রটির সঙ্গে আর্থিক চুক্তিতেই অবৈধভাবে দেশ ছাড়েন পলাতক নেতারা। এই চক্রটি রোহিঙ্গাদেরও পারাপার করে থাকে।
গত রবিবার সকালে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নের এক বাজার থেকে দুই রোহিঙ্গাসহ ৫ জনকে আটক করে স্থানীয়রা। আটককৃতরা লাঠিটিলা সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আটককৃত দুই রোহিঙ্গা হলেন: কুতুপালংয়ের ১৮ নাম্বার ক্যাম্পের আলী আকবরের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান ও আমান উল্লার মেয়ে আসমা বিবি। বাংলাদেশি তিনজন হলেন খুলনার তেরখাদা উপজেলার আজুপাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিম সরদারের ছেলে আবু হানিফ সরকার, মেয়ে নীলিমা খাতুন ও আবু হানিফ সরকারের স্ত্রী একই গ্রামের নজরুল হাওলাদারের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার। বিষয়টি নিশ্চিত করেন জুড়ী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান।
গত শনিবার সিলেটে জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে আটক হয়েছেন জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল আহমদ। শনিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে উপজেলার গোয়াবাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তাকে আটক করে বিজিবি।
একাধিক সূত্র দাবি করেছে, ৫ আগস্ট সিলেট সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন ছাত্রলীগের অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তারা দেশত্যাগ করেন বলে জানা গেছে। পরে সিলেটের সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান, সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট রঞ্জিত সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা আজাদুর রহমান আজাদসহ বহু নেতা সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
কানাইঘাটের ডোনা ডোনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটক হয়েছিলেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিক। গ্রেপ্তারের পর আলোচিত এ সাবেক বিচারপতি জানিয়েছিলেন, সীমান্তে দালাল ধরে তিনি ভারতে প্রবেশের চেষ্টা চালান। পরে ওই দালালরাই তাকে মারধর করে সঙ্গে থাকা ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে গেছে।
কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্মীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের মেম্বার নাজিম উদ্দিন দাবি করেন, সীমান্তের চোরাকারবারে যারা সক্রিয় তাদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। সাদ্দাম ও রহিম নামে দুজন ওই সীমান্ত এলাকার সব অপরাধের মূলহোতা। বিচারপতি আটকের পর তারা পালিয়েছে কিন্তু তাদের টক্রের তৎপরতা বন্ধ হয়নি।