খেলাপি ঋণ ইস্যুতে ১৩ ব্যাংকের লভ্যাংশ নিয়ে শঙ্কা

আলমগীর হোসেন ও মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ ঘোষণার নীতিমালা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতিমালায় ব্যাংকগুলো আগের পুঞ্জীভূত মুনাফা হতে কোন নগদ লভ্যাংশ বিতরণ করতে পারবে না। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত বছরের লভ্যাংশ ঘোষণা থেকে কার্যকর হবে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফ-সাইট সুপারভিশন এ তথ্য জানায়। তবে এ তথ্য প্রকাশের পর ব্যাংক খাতের শেয়ার হোল্ডাররা রয়েছে দু:শ্চিন্তায়। মুলত খেলাপি ঋণ ইস্যুতে ১৩ ব্যাংকের লভ্যাংশ নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
অন্যদিকে বিগত সরকারের সময়ে দেশের ব্যাংক খাত ও পুঁজিবাজার ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তখনকার সরকারের সরাসরি মদতে এসব খাতে লুটপাট হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন নেতৃত্ব সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ দেয়া নিয়ে নতুন নিয়ম করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ-সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব শেয়ার দরের ওপরে পড়েছে বলে মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে। নামে-বেনামে এ খাত থেকে টাকা বের করে নেওয়া হয়েছে। এসব অর্থের বেশিরভাগ বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এতে কয়েকটি ব্যাংক খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তা দেয়ায় সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এটি কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।
আর এজন্যই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থার ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। আর লভ্যাংশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর জন্য খেলাপির যে শর্ত দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে অধিকাংশ ব্যাংকই লভ্যাংশ দিতে পারবে না। কারণ বেশিরভাগ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গত ছয় মাসে ব্যাপকহারে বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এটি মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ। বর্তমানের এ খেলাপি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২ লাখ ১৩১ কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে ৬০ শতাংশের ওপরে খেলাপি ঋণ রয়েছে ৮টি ব্যাংকের। এর মধ্যে বিদেশি ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের খেলাপি ঋণ ৯৮ দশমিক ৭০ শতাংশ।
বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপি ৯০ দশমিক ৭২ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৮৭ দশমিক ৯৮ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের ৮৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ, রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ৭২ শতাংশ, বেসিক ব্যাংকের ৬৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৬২ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬০ দশমিক ৫০ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছে।
এছাড়া ১০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে খেলাপি ঋণ রয়েছে ১৫টি ব্যাংকের। এর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৩৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ৩৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ, রূপালী ব্যাংকের ৩১ দশমিক ৭৩ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০ দশমিক ৮৬ শতাংশ,
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ২৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ২১ দশমিক ০৮ শতাংশ, সোনালী ব্যাংকের ১৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ১৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১২ দশমিক ১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ব্যাংক এশিয়ার খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে অবস্থান করছে।
ব্যাংকের ডিভিডেন্ড দেওয়া নিয়ে সম্প্রতি নতুন একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন নীতিমালা অনুযায়ি, কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের বেশি হলে ঐ ব্যাংক আর ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। ২০২৫ সালের ব্যবসায় ডিভিডেন্ড দেওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালাটি কার্যকর হবে। এর আগে করোনার সময় ২০২০ সাল থেকে ডিভিডেন্ড বিতরণের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে আসছে। এতদিন কেবল প্রভিশন সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধা নেওয়া ব্যাংকের ডিভিডেন্ড বিতরণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ছিল। এবার নতুন করে নানা রকম শর্ত যুক্ত করা হয়েছে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, একটি ব্যাংক কেবল বিবেচ্য পঞ্জিকাবর্ষের মুনাফা থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। কোনোভাবেই পুঞ্জীভূত মুনাফা থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ড বিতরণ করা যাবে না। এক্ষেত্রেও আরো কিছু শর্ত মানতে হবে। কোনো ব্যাংকের শ্রেণিকৃত ঋণের হার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের বেশি হলে ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। ঋণ, বিনিয়োগ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে কোনো ধরনের সংস্থান ঘাটতি থাকা যাবে না।
এছাড়া, যদি কোনও ব্যাংকের জমার হার বা লিকুইডিটি ঘাটতি থাকে, কিংবা যদি তারা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনও ঋণ সুবিধা নেয়, তবে তারা ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। ডিভিডেন্ডের পরিমাণও নির্দিষ্ট করা হয়েছে তা মূলধনের ৩০ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। তবে, যেসব ব্যাংক তাদের মূলধন যথেষ্ট পরিমাণে সংরক্ষণ করতে পারবে, তারা শর্ত অনুযায়ী ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
আবার সিআরআর ও এসএলআর ঘাটতির কারণে আরোপিত দণ্ড সুদ ও জরিমানা অনাদায়ি থাকলে ডিভিডেন্ড দিতে পারবে না। প্রভিশন সংরক্ষণসহ অন্যান্য ব্যয় মেটানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডেফারেল সুবিধা বহাল থাকা অবস্থায় ডিভিডেন্ড দেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২২ ও ২৪ ধারা যথাযথ পরিপালন করতে হবে। পুঁজিবাজারের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে: ন্যাশনাল ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, রূপালি ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক ও ব্যাংক এশিয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ি, বর্তমানে খেলাপী ঋণের পরিমাণ: আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৯০.৭২ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৮৭.৯৮ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬০.৫০ শতাংশ, আইএফআইসি ব্যাংকের ৩৮.৫৯ শতাংশ , সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩৪.৭৯ শতাংশ, রূপালি ব্যাংকের ৩১,৭৩ শতাংশ, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০.৮৬ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৯.৩৩ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ২৫.৯৯ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংকের ২১.০৮ শতাংশ, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১২.১১ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংকের ১০.৫৮ শতাংশ ও ব্যাংক এশিয়ার ১০ শতাংশ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নীতিমালা ২০২৫ সালের ডিভিডেন্ড ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। ২০২৪ সালের ডিভিডেন্ড ঘোষণার ক্ষেত্রে ২০২১ সালের নির্দেশনা অনুসরণ করতে হবে। তবে পূর্বের নির্দেশনায় ডেফারেল সুবিধা গ্রহণকারী ব্যাংকগুলোর জন্য ৫ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়ার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। এর ফলে ডেফারেল সুবিধা গ্রহণকারী ব্যাংক ২০২৪ সালের জন্য কোন ধরনের ডিভিডেন্ড বিতরণ করতে পারবে না।
তবে নতুন নীতিমালা নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের কঠোর নীতিমালার ফলে ব্যাংকগুলো তাদের ব্যালেন্স শিট শক্তিশালী করতে উদ্যমী হবে এবং শেয়ারহোল্ডারদের রিটার্নের চেয়ে বেশি নজর দেবে আমানতের সুরক্ষায়।