স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তার আশায় একটি বিমা কোম্পানি থেকে বিমা পলিসি কেনেন রবি পাল। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আয় করা অর্থের একটি অংশ জমিয়ে ১০ বছর নিয়মিত বিমা পলিসির টাকা পরিশোধ করেন। প্রিমিয়ামের টাকা দিতে অনিয়ম না করলেও তিনি এখন বিমা দাবির টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। বিমার টাকা ফেরত পেতে তাকে ধরনা দিতে হচ্ছে দ্বারে দ্বারে।

রবি পাল বলেন, বিমা কোম্পানির এজেন্ট পলিসি বিক্রির সময় বলেছিল মেয়াদ শেষে মুনাফাসহ দ্বিগুণ টাকা পাওয়া যাবে। আমার পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে ছয় মাসের বেশি হয়ে গেছে। কোম্পানির লোকের কাছে বারবার যাচ্ছি, কিন্তু বিমার টাকা পাচ্ছি না।

হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে আয় করা টাকা দিয়ে বিমা পলিসি কিনি। এখন সে টাকাই ফিরে পাচ্ছি না। জানি না কবে টাকা ফেরত পাবো। ‘শুধু আমি না, আমার এলাকার অনেকের বিমা পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে, তারাও টাকা ফেরত পাচ্ছে না। যার মাধ্যমে বিমা পলিসি কিনি সে ও বলতে পারছে না কবে টাকা পাবো। সে শুধু বলে হেড অফিস থেকে চেক পাঠালেই পেয়ে যাবেন। আমাদের পক্ষে তো হেড অফিসে যোগাযোগ করা সম্ভব না’ বলেন এ ভুক্তভোগী।

শুধু রবি পাল নন, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার হাজার গ্রাহক বিমা দাবির টাকা পেতে নানা বিড়ম্বনায় পড়ছেন। দেশে ব্যবসা করা বেশিরভাগ বিমা কোম্পানি সঠিকভাবে সময় মতো গ্রাহকদের বিমা দাবির টাকা দিচ্ছে না। ফলে বিমার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমছে। এতে বিমা কোম্পানিগুলোও প্রতিনিয়ত গ্রাহক হারাচ্ছে।

এদিকে বিমা করেছেন, কিস্তি দিয়েছেন নিয়মিত, কিন্তু টাকা ফেরত পাচ্ছেন না গ্রাহক দেশের জীবনবিমা খাতে এ রকম ঘটনা যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ৩২টি জীবনবিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের আটকে থাকা টাকার পরিমাণ অন্তত ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি। বিমার টাকা আদায়ে প্রতিদিনই এসব কোম্পানির অফিসে ধরনা দিচ্ছেন গ্রাহক। অনেকে চার-পাঁচ বছর ঘুরেও টাকা আদায় করতে পারছেন না।

বিমা মেয়াদ শেষ হওয়ার ১০ বছর পেরিয়ে গেলে এখন পর্যন্ত টাকা পাচ্ছেন না বাগেরহাটের আশিকুর রহমান আশিক। মোরেলগঞ্জ থেকে রাজধানীর বিজয়নগরে বায়রা লাইফ ইনস্যুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে বিমার টাকা চাইতে আসা আশিক বলেন, এজেন্ট ও কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছিলেন ৫০ হাজার টাকার বিমা করলে ১ লাখ টাকা পাব। লাভ তো পেলামই না, মামলা করার পরও মূল টাকা ফেরত পাচ্ছি না।

তিনি জানান, ২০০৫ সালে করা বিমার মেয়াদ শেষ হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকেই বিমা দাবি নিয়ে তিনি ঘুরছেন বায়রা লাইফের স্থানীয় ও প্রধান কার্যালয়ে। টাকার জন্য এ নিয়ে ২১ বার রাজধানীতে এসেছেন তিনি।

বায়রা লাইফ টাকা না দেওয়ায় আইডিআরএ, এমনকি আদালত পর্যন্ত গেছেন; কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। আশিকের মতোই বিমার টাকার জন্য ৯ বছর ধরে ঘুরছেন কুড়িগ্রামের রিকশাচালক সুজন খন্দকার। আর চার বছর ধরে সব ধরনের চেষ্টা করেও বিমার টাকা পাননি বগুড়ার মুহতাদিয়া বানু। বিমা আইন ২০১০ অনুসারে, পলিসির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের কাছে সব কাগজপত্র জমা দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে বিমা দাবি নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ বিমা কোম্পানি এ নিয়ম মানছে না।

আইডিআরএর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন বিমা কোম্পানিতে গ্রাহকদের বকেয়া বিমা দাবি ছিল প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। এরপরের তিন মাসেই তা থেকে বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লোপাট ও স্বজনপ্রীতির কারণে অর্থ সংকটে পড়ে গ্রাহকের টাকা নিয়ে গড়িমসি করছে কোম্পানিগুলো।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সময়মতো বিমার টাকা পরিশোধ না করা বিমা খাতের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। ফলে মানুষ বিমা খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আর এ কারণে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

আইডিআরএর সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জীবনবিমা খাতে গ্রাহকের অপরিশোধিত অর্থের ৮০ ভাগই আটকে রেখেছে ৫টি বিমা কোম্পানি। বিমা দাবি পরিশোধে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সানফ্লাওয়ার লাইফ ইনস্যুরেন্স। বিকল্পধারার সাবেক মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নানের এই প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের পাওনা ৫৯৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। কোম্পানিটি বিমা দাবির ৯৭ দশমিক ৮৭ শতাংশই পরিশোধ করেনি।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, যা বলার আইডিআরএকে বলেছি। ৯৫ দশমিক ৫১ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ না করায় গ্রাহকের টাকা আটকে রাখার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে এস আলম গ্রুপের পদ্মা ইসলামী লাইফ। প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকের পাওনা ২৬১ কোটি টাকা।

এ ছাড়া ফারইস্ট ইসলামী লাইফ গ্রাহকের ২ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা আটকে রেখেছে, যা প্রতিষ্ঠানটির মোট বিমা দাবির ৯৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। ফারইস্ট ইসলামী লাইফে এস আলমের পাশাপাশি ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সালমান এফ রহমানের।

বিষয়টি নিয়ে জানতে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্সের ভারপ্রাপ্ত সিইও শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ১০-১২ বছরে কোম্পানির প্রায় ৩২০০ কোটি টাকা লুট হয়েছে। ফলে হাতে নগদ টাকা নেই। গ্রাহকের টাকা পরিশোধে গুলশান ও ফেনীতে সম্পদ বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে।

যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ আবুল বাসারের বায়রা লাইফে গ্রাহকের বিমা দাবির ৯২ দশমিক ৫৮ শতাংশই বকেয়া, যা টাকার অঙ্কে ৮৩ কোটি। এ ছাড়া ৮২ দশমিক ৩২ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ না করে পঞ্চম স্থানে রয়েছে প্রগ্রেসিভ লাইভ ইনস্যুরেন্স। প্রতিষ্ঠানটির কাছে গ্রাহকের বকেয়ার পরিমাণ ২০১ কোটি টাকা।
বায়রা লাইফের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মামুন খান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে বড় অংশের দাবি পরিশোধ করতে পারব। মালিবাগে কোম্পানির জমি বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। ৭৩ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের পারিবারিক কোম্পানি সানলাইফ ইনস্যুরেন্স।

এ ছাড়া এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রেডিসেন্ট জসিম উদ্দিনের মালিকানাধীন কোম্পানি বেঙ্গল ইসলামী লাইফ ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রয়াত ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার ডায়মন্ড লাইফ ৩৩ শতাংশ এবং সরকারি জীবনবিমা কোম্পানি ১৪ শতাংশ দাবি পরিশোধ করেনি।

একইভাবে এস আলম গ্রুপের আরেক প্রতিষ্ঠান প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স ১০ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোরশেদ আলমের ন্যাশনাল লাইফ গ্রাহকদের ৮ শতাংশ বিমা দাবি পরিশোধ করেনি। প্রাইম ইসলামী লাইফের সিইও সামসুল আলম বলেন, ৩০৬ কোটি টাকা দাবির কথাটি সঠিক নয়, বকেয়া বিমা দাবির পরিমাণ ৩৮ কোটি টাকা। কোম্পানির ফ্ল্যাট-প্লট রয়েছে, তা বিক্রি করে বিমার টাকা দেওয়া শুরু করেছি।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এক দশক আগেও দেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ শতাংশ, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.৪৫ শতাংশে। অর্থাৎ বিমা খাত বিস্তারের বিপরীতে আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। আস্থা হারানোর প্রধান সমস্যা বিমা দাবি পরিশোধ না করা। অনিষ্পন্ন দাবির অঙ্ক বাড়ায়, আর্থিক শৃঙ্খলার জন্য উদ্বেগজনক।

প্রগতি লাইফ ইনস্যুরেন্সের সিইও জালালুল আজিম বলেন, বিমা দাবির টাকা ফেরত না পাওয়ার কারণে জনগণের আস্থা হারাচ্ছে। ফলে খাতটি দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না। তবে সংকটের মধ্যেও কিছু কোম্পানি আছে, যারা ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত বিমা দাবি পরিশোধ করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে পপুলার লাইফ ইনস্যুরেন্স, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ, চার্টার্ড লাইফ, সোনালী লাইফ, মার্কেন্টাইল, সন্ধানী, মেঘনা ও রূপালী লাইফ ইনস্যুরেন্স।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইডিআরএর চেয়ারম্যান আসলাম আলম বলেন, কয়েকটি কোম্পানির অনিয়ম পুরো বিমা খাতের ওপর প্রভাব ফেলছে। আমরা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বসে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করেছি। সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিনা শেখ বলেন, বিমা কোম্পানিগুলোর দাবি পরিশোধে আইডিআরএকে আরও কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে তাদের ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল করে দিতে হবে।