মিজানুর রহমান, দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: বহুমুখী সংকটে ডুবছে প্রকৌশলী খাতের কোম্পানি ইফাদ অটো। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধিতে এরই মধ্যে পুঁজিবাজারের প্রকৌশলী খাতের কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় বিপর্যয়ের চিত্র ফুটে উঠেছে। বাড়তি ব্যয় ঝুঁকিতে পড়ছে ইফাদ অটো। ফলে প্রকৌশলী খাতের ইফাদ অটো কোম্পানিটির শেয়ারের দর হারিয়েছে প্রায় চারশত শতাংশ। এছাড়া কোম্পানির রয়েছে ঋণের পাহাড়। পরিশোধিত মুলধণের কয়েকগুন বেশি কোম্পানিটির ঋণ রয়েছে।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির পর অনেক সময় কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির আগে ও পরে ব্যবসায়িক কার্যক্রমে দুই রকম চিত্র ফুটে ওঠে। তালিকাভুক্তির আগে কোম্পানিটি বিপুল পরিমাণে মুনাফা করেছিল, সেই কোম্পানিটিই তালিকাভুক্তির পর ধারাবাহিক মুনাফা কমছে। শুধু ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোম্পানির প্রকৃত চিত্র গোপন করে তালিকাভুক্তির কারণেই এমনটি ঘটছে। আর এজন্য কোম্পানির তালিকাভুক্তির সহায়ক ইস্যু ম্যানেজারের দিকে আঙ্গুল তুলেছেন বিনিয়োগকারীসহ বাজার-সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, অন্য যে কোনো উৎসের তুলনায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন কোম্পানির জন্য বেশ সুবিধাজনক। আর তাই তালিকাভুক্তির জন্য আবেদনের আগেই দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে অনেক কোম্পানি। এ ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর দুর্নীতির অন্যতম সহায়ক ইস্যু ম্যানেজার। ইস্যু ম্যানেজার ও মার্চেন্ট ব্যাংক কোম্পানির দুর্নীতির কথা জেনেও তালিকাভুক্ত হতে সহায়তা করছে।

এমনি একটি কোম্পানি হলো পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত প্রকৌশলী খাতের ইফাদ অটো। ৩০ টাকা প্রিমিয়াম নিয়ে কোম্পানিটি ২০১৫ সালে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৩৮ টাকার ঘরে। তালিকাভুক্তির পাঁচ বছরের মাথায় কোম্পানিটির শেয়ার দর হারিয়েছে প্রায় চারশত শতাংশ। কোম্পানিটির মুনাফার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে রিজার্ভ ফান্ডে। এছাড়া মুলত ব্যবসা সম্প্রসারনের লক্ষ্যে রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করলেও ধারাবাহিকভাবে মুনাফায় ধ্বস নামছে ইফাদ অটো।

জানা যায়, ইফাদ অটোস ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। কোম্পানিটি ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের সঙ্গে ২০ টাকা প্রিমিয়ার যোগ করে ৩০ টাকা দরে ২ কোটি ৫০ লাখ শেয়ার ইস্যু করে শেয়ারবাজার থেকে ৬৩ কোটি ৭৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা উত্তোলন করে। তালিকাভুক্তির বছরে (২০১৪ হিসাব বছর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় দেখানো হয়েছিল ৫.১৬ টাকা।

কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০১৫ হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয়ে ধ্বস নামে। এবছর কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় আসে ৩.৫১ টাকা। তবে বিনিয়োগকারীদের খুশি রাখার জন্য কোম্পানিটি ভালো লভ্যাংশ ঘোষণা করে। ওই বছর কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের ৭ শতাংশ নগদ ও ৩০ শতাংশ বোনাস মিলিয়ে ৩৭ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়। পরের বছর ২০১৬ হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় ২০১৫ সালের তুলনায় বাড়ে। এবছর এর শেয়ারপ্রতি আয় আসে ৩.৯৮ টাকা।

কিন্তু এবছর আয় বাড়লেও লভ্যাংশ কমে যায়। এবছর বিনিয়োগকারীদের ১৩ শতাংশ নগদ ও ৪ শতাংশ বোনাস মিলিয়ে মোট ১৭ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হয়। অর্থাৎ মুনাফার ৪২.৭১ শতাংশ বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ হিসাবে দেয়া হয়। অবশিষ্ট ৫৭.২৯ শতাংশ রিজার্ভ ফান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। এবছর ২০১৭ হিসাব বছরে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি আয় আসে ৬.৭৪ টাকা। আর বিনিয়োগকারীদের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করে ২৬ শতাংশ (২১ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস)।

অর্থাৎ মুনাফার মাত্র ৩৩.৫৩ শতাংশ লভ্যাংশ হিসাবে পাচ্ছে বিনিযোগকারীরা। অবশিষ্ট ৬৬.৪৭ শতাংশ চলে যাচ্ছে কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ডে। তেমনি রাইট ইস্যুর পর ২০১৮ সালে কোম্পানিটির মুনাফা আকাশ কুসুম বেড়ে ১৫৫ কোটি টাকা মুনাফা করলেও ইপিএসে বড় ধরনের উত্থান ঘটে। ঐ বছর কোম্পানিটির ইপিএস হয় ৭.০১ টাকা। রাইট ইস্যুর পর বিনিয়োগকারীদের খুশি রাখার জন্য ২২ শতাংশ ক্যাশ ও ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ড ঘোষণা দেয়।

কিন্তু ২০১৯ সালে এসে কোম্পানির মুনাফায় ধ্বস নেমে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ৪.৫৯ টাকা, তেমনি ডিভিডেন্ডে ধ্বস নেমে। গত পাঁচ বছরের তুলনায় সর্বনিন্ম ডিভিডেন্ড ১০ শতাংশ নগদ ঘোষণা করে।

বিনিয়োগকারীরা বলছেন, তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানির পরিচালকরা শেয়ারদর ভালো রাখার জন্য খাতে-কলমে মুনাফা বেশি দেখায়। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য লভ্যাংশ দেয় না। বিনিয়োগকারীদের ন্যায্য লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত করা মানেই কোম্পানির মুনাফায় কারসাজির ইংগিত বহন করে বলে তারা অভিযোগ করেছেন।

এছাড়া ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে: ইলেকট্রিক পণ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে ইফাদ গ্রুপ। বর্তমানে গাড়ি, ভোগ্যপণ্য ও আইটি ব্যবসা করছে। গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানটি ভ্যাট নিবন্ধনহীন প্রতিষ্ঠান থেকে কাঁচামাল কেনা ও কাঁচামাল সরবরাহে উৎসে ভ্যাট পরিশোধ না করার মাধ্যমে এ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।

এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি আইন অমান্য করে অতিরিক্ত রেয়াতও নিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিরীক্ষায় সুদসহ প্রায় ১২৫ কোটি টাকার ফাঁকি উঠে এসেছে। এ ভ্যাট পরিশোধে সম্প্রতি কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট, ঢাকা (পশ্চিম) দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করেছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে ইফাদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, ‘দাবিনামা জারি করেছে। আমরা জবাব দিতে সময় চেয়েছি। ভ্যাট অফিস একটা জায়গায় বলেছে, আমাকেও তো দেখতে হবে কোথায়, কোন জায়গায় কী বলেছে। এসব দেখে আমরা জবাব দেব।’

সূত্র জানায়, ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টস লিমিটেড ইফাদ ব্র্যান্ডের আটা, বিভিন্ন প্রকার বিস্কুট, নুডলস, ড্রিংকিং ওয়াটার প্রভৃতি পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৫ সালে নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক নিরীক্ষা, গোয়ে