দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা : পুঁজিবাজারের একমাত্র রাষ্ট্রিয় বিনিয়োগপ্রতিষ্ঠান আইসিবি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংককে লুটেপুটে খাচ্ছে এমন অভিযোগ এখন ওপেন সিক্রেট। শেয়ারবাজার তথা পুঁজিবাজারের সর্বত্র সবখানে আইসিবির এহনো দু’নাম্বারী কারবার নিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের মুখে মুখে মুখরোচক আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে। একাধিক সুত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর টাকা ফেরত পেতে আইসিবিকে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও এফডিআর হিসেবে রাখা টাকা পাচ্ছে না।

সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিতে (ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ) টাকা রেখে বিপাকে পড়েছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন জনতা, সোনালী, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা ৩ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটি আমানতের বিপরীতে একদিকে সুদ দিচ্ছে না উল্টো ব্যাংকগুলোর মূল টাকাও ফেরত দিচ্ছে না।

বিশ্লেষকদের মতে, মেয়াদ শেষেও আমানত ফেরত না দিলে প্রতিষ্ঠানগুলোর সিআরআর সংরক্ষণে সমস্যা হয়। সময়মতো টাকা ফেরত না দিলে পারস্পরিক আস্থা বিনষ্ট হলে মুদ্রাবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুদ্রাবাজারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইসিবির উচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর জমা রাখা টাকা ফিরিয়ে দেওয়া।

সূত্রে জানা যায়, আইসিবিতে সোনালী ব্যাংকের মেয়াদি আমানত হিসেবে ১ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৪৮০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকের ৪৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। আইসিবিতে রাখা অধিকাংশ এফডিআরের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ব্যাংকগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে একদিকে সুদ পাচ্ছে না অন্যদিকে আসল টাকাও ফেরত পাচ্ছে না। এফডিআরের টাকা ফেরত পেতে আইসিবিকে বারবার তাগাদা দিয়েও কোনো সাড়া মিলছে না।

এদিকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নগদ তারল্য সংরক্ষণের (সিআরআর) জন্য কলমানি, মেয়াদি আমানত, আন্তঃব্যাংক রেপো, রিভার্স রেপো, স্পেশাল রেপো অ্যাসুউরড লিকিউডিটি সাপোর্ট (এএলএস) মুদ্রাবাজারের তারল্যের উপাদান হিসেবে বিবেচিত। তাই মুদ্রাবাজারের প্রচলিত নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মেয়াদ শেষেও আমানত ফেরত না দিলে সিআরআর সংরক্ষণে সমস্যা হয়। এ ছাড়া পারস্পরিক আস্থা বিনষ্ট হলে মুদ্রাবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকার পরও আইসিবি টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এ অবস্থায় মুদ্রাবাজারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা টাকা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চায় ব্যাংকগুলো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাষ্ট্রায়ত্ত এক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আইসিবি থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেছি। এরপরও এফডিআরের টাকা ফেরত আসছে না। তাই মৌখিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে টাকা আদায়ের জন্য হস্তক্ষেপ চেয়েছি। এরপরও এফডিআরের টাকা ফেরত না পেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শামস-উল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, আইসিবি থেকে এ অবস্থায় আমাদের এফডিআর তুলে নিলে ক্যাপিটাল মার্কেটে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আমরা চাই ক্যাপিটাল মার্কেট চাঙ্গা থাকুক, যেহেতু ক্যাপিটাল মার্কেট তাদের দ্বারাই উপকৃত হচ্ছে। এমনিতেই শেয়ারবাজারের অবস্থা ভালো না। সরকারি ব্যাংকের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা শুধু লাভ দেখব কেন, দেশের অর্থনীতিও দেখব। সুতরাং ওরা সুদ দিলে আমরা রিনিউ করব। এ ব্যাপারে বোর্ড মিটিংয়ে কথা হয়েছে এবং আইসিবি সুদ পরিশোধ করবে বলেছে।

এ ব্যাপারে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, আমানত ফেরত দেওয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই। ব্যাংকগুলোর মূল টাকা ফেরত দিতে তারা বলছে। নিয়ম আছে সুদ দিলে রিনিউ করার। আমরা সুদ পরিশোধ করলে ওরা রিনিউ করে দেবে, নিয়ম তো তাই। ইতোমধ্যে রূপালী ব্যাংক রিনিউ করেছে। সোনালী ব্যাংকও রিনিউ করবে বলেছে। তবে মূল টাকা ফেরত দেওয়ার মতো অবস্থা আমাদের নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম দৈনিক দেশ প্রতিক্ষণকে বলেন, মেয়াদ শেষ হলে টাকা ফেরত দেওয়া প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। যারা টাকা ফেরত দিতে পারছে না তাদের তাগাদা দেওয়া হবে। এদিকে জানা যায়, আইসিবি যে ১০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এফডিআর করেছে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই অবস্থা খুবই নাজুক। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের আমানত ফেরত দিতে পারছে না। আইসিবির এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাজার উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত আইসিবি তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসে মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করছে। ফলে মুদ্রাবাজার থেকে নেওয়া তহবিল আবার মুদ্রাবাজারেই ফিরে আসছে। এতে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।