দেশ প্রতিক্ষণ, ঢাকা: পুঁজিবাজারে লেনদেন কমে আসায় প্রশ্ন উঠেছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দেয়া মার্জিন ঋণের নির্দেশনা নিয়ে। সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদে মার্জিন ঋণের দেয়ার নির্দেশনার পরই মূলত হাজার কোটি টাকার ঘর থেকে সরে আসে লেনদেন। এরপর গত ২২ ফেব্রুয়ারি চারশ কোটি টাকায় ঘরেও শেষ হয়েছে পুঁজিবাজারের লেনদেন। আবারও ঘুরে ফিরে চারশ কোটিতে পুঁজিবাজার।

সম্প্রতি পুঁজিবাজারের মন্দা থেকে উত্তরণে বৈঠকে বসে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোয়েশন, ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনসহ শীর্ষ ১০ ব্রোকারেস হাউজ। সেখানে পুঁজিবাজারের লেনদেন বাড়ানো, করোনা মহামারি বেড়ে যাওয়ায় লেনদেন বন্ধের গুজব থেকে রক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনায় স্থায় পায় মার্জিন ঋণের বিষয়টি। ওই বৈঠকে মার্জিন ঋণের সুদহার ১২ শতাংশ করার নির্দেশনা এক বছর পেছানোর অনুরোধ করে। তবে বিএসইসি এখনও সিদ্ধান্ত জানায়নি।

বিভিন্ন হাউজে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়। জুলাই থেকে সুদহার যদি ১২ শতাংশ হয়, তাহলে সমন্বয় করা ঝামেলার হয়ে যাবে বলে ঋণ এখন অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে তারা। কোনো কোনো হাউজ ঋণ নিতে নিরুৎসাহিত করে আগের ঋণ সমন্বয় করতে বলেছে।

বর্তমানে অনেক মার্চেন্ট ব্যাংক নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেখানে এখনও ঋণের সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। ফলে প্রশ্ন উঠে, সর্বোচ্চ ১২ শতাংশে ঋণ নিয়ে কীভাবে ১২ শতাংশে ঋণ দেয়া হবে।

এ বিষয়ে ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্টমন্টে লিমিটেডের সাবেক গবেষণা কর্মকর্তা দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়া গতি কমিয়ে দেয়ার কারণে লেনদেন কমতে পারে, এটা অস্বাভাবিক কিছু না।’ তবে মার্জিন ঋণ নিয়ে বিএসইসি যে নির্দেশনা দিয়েছে, সেটি বাস্তবসম্মত বলেই তিনি মনে করেন। বলেন, ‘বতর্মানে যে কয়টি

মার্চেন্ট ব্যাংক আছে তার সিংহভাগই কোনো না কোনো ব্যাংকের। এখন ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদের ঋণ দিচ্ছে। তাহলে নিশ্চয় সহযোগী প্রতিষ্ঠানকেও একই হারে বা তারচেয়ে কম হারে ঋণ দিতে পারে। তারপরও কেন সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ হারে পুঁজিবাজারে ঋণ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না সেটিই প্রশ্ন।’ তবে বিএমবিএর প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে যদি পুঁজিবাজারের ভালো হলে সেটি মেনে নেয়ার পক্ষেও এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি পুঁজিবাজারকে আরও গতিশীল করতে গত কয়েক মাসে নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেগুলোর প্রশংসা হচ্ছিল। এসব সিদ্ধান্তের একটি ছিল মার্জিন ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেয়া। নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে, ব্রোকারেজ হাউজ বিনিয়োগকারীদের ঋণ নিয়ে সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। তবে আমানতের তুলনায় ঋণের সুদহার ৩ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।

অর্থাৎ ব্রোকারেজ হাউজ যদি ৬ শতাংশ সুদে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে, তাহলে তারা ঋণের সুদ নিতে পারবে ৯ শতাংশ। বর্তমানে মার্জিন ঋণে সুদহার নির্দিষ্ট না থাকায় কোনো কোনো হাউজ ১৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নিয়ে থাকে, যদিও এখন দেশে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ।

১৪ জানুয়ারি বিএসইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সিদ্ধান্তটি কার্যকর হবে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। গত ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে উত্থানের পর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিনই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ-ডিএসইর সূচক ছিল সর্বোচ্চ অবস্থানে, ৫ হাজার ৯০৯ পয়েন্টে। লেনদেন ছিল ২ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

এই সিদ্ধান্ত বিনিয়োগকারীদের আরও আশান্বিত করলেও পরের দুই দিনে সূচক পড়ে ১০৯ পয়েন্ট। এর পর তিন দিন অল্প অল্প করে সূচক বাড়ে ৩৬ পয়েন্ট। এরপর থেকে ওঠানামা করতে করতে সূচক পড়ার পাশাপাশি কমতে থাকে লেনদেন। এর মধ্যে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর অনুরোধে বিএসইসি এই সিদ্ধান্ত কার্যকরে পাঁচ মাস পেছায়।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১২ শতাংশ সুদহার কার্যকর হবে আগামী জুলাই থেকে। নতুন সিদ্ধান্তেও বাজারে তারল্য বাড়েনি। যে বাজারে জানুয়ারিতে টানা ১০ দিন গড়ে ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা এবং টানা ৪০ দিন এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে, সেখানে এখন গড় লেনদেন ৬০০ কোটি টাকার ঘরে। মাঝে তা ৫০০ কোটি টাকারও নিচে নেমে আসে। বৃহস্পতিবার সূচক দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩২৭ পয়েন্টে। লেনদেন হয় ৪৬৭ কোটি টাকা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ সহজভাবে বললেন, যারা ১২ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ নিয়েছেন তারা কিভাবে ১২ শতাংশের কমে ঋণ দেবেন। জুলাই পর্যন্ত সময় থাকলেও যারা বেশি হারে ঋণ নিয়েছেন তাদের সমন্বয় করতে আরও সময় দেয়া প্রয়োজন।
একই বক্তব্য জানালেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘বিএসইসির যে নির্দেশনা দিয়েছে সেটি পরিপালনে আমাদের কোনো অনীহা নেই। আমাদের ১২ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হলে কম সুদের ফান্ড প্রয়োজন হবে। যখনই আমরা কম সুদের ঋণ নিতে পারব তখনই কেবল সর্বোচ্চ ১২ শতাংশের শর্তানুযায়ী ঋণ দেয়া সম্ভব হবে। এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানের ১১ শতাংশের বেশি হারে ঋণ নেয়া আছে। সেটি এখন চাইলেই সমন্বয় করা সম্ভব নয়।’

তিনি বলেন, ‘এ জন্য আমাদের সময় প্রয়োজন। আমরা বিএসইসির কাছে এক বছর সময় চেয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে সব ঋণ সমন্বয় করে কম সুদে ফান্ড সংগ্রহ করে সমন্বয় করা সম্ভব হবে।’ তবে পুঁজিবাজারের এমন পতন বেশি দিন থাকবে না উল্লেখ করে বিএমবিএ সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘যে কারণেই পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেনের পতন হোক না কেন, সেটি সাময়িক। শিগগিরই বাজার ভালো অবস্থায় ফিরবে।’সূত্র: নিউজবাংলা